অনুভূতি - ২ (পর্ব-১)

 



অনুভূতি-১ নামের লেখাটার কথা মনে আছে তো আপনাদের ? ওটা পুরোপুরি কাল্পনিক লেখা না ওটা আমার জীবনের কিছু ঘটনা থেকেই আমি লিখেছিলাম তো সেই ঘটনা থেকেই আবার নতুন আরেকটা ঘটনার সূত্রপাত। 

[যেহেতু বলেই দিলাম যে ঘটনা পুরোপুরি কাল্পনিক না তাই অনুভূতি-১ লেখাটাতে কিছু তথ্যের পরিবর্তন করতে হয়েছে, যদিও পরিবর্তন হয়েছে খুব সামান্য তাই আগে যারা লেখাটি পড়েছেন তারা আরেকবার রিভিউ করে নিলে ভালো হয়৷ না হলে এই লেখার ঘটনা গুলি অসংলগ্ন লাগবে। আর যারা অনুভূতি-১ লেখাটা আগে পড়েননি তারা অনুগ্রহপূর্বক পড়ে নিবেন নাহলে এই লেখাটার অধিকাংশ বা মূল অংশটাই বুঝতে পারবেন না। ধন্যবাদ।

লিংক https://tanymsenvisions.blogspot.com/2022/10/blog-post.html


রাইসা কে নিয়ে পরে নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম। সেই বিষাক্ত তো ঘন তরল অন্ধকার আমার জীবন থেকে সরে গেলেও অনুভূতিটা কিন্তু আমার যায়নি। আর তার সাথে যোগ হয়েছে আরো নতুন কিছু চরিত্র। এলাকার কিছু ছেলে ছোকড়াদের সাথে বসে আড্ডা দিতাম চায়ের দোকানে।তারা আমার কাছে আমার অনুভূতির গল্প গুলো শুনতে চাইতো, ব্যাপারটা গোপন থাকে নি আর কি। আমিও বলতাম, বলতে ভালই লাগতো আর কি। যে দুটো ব্যবসা শুরু করেছিলাম তার মধ্যে একটা বেশ ভালোভাবেই দাঁড়িয়েছে। পুরাতন গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি, একটা নতুন গাড়ি নিয়েছি, Audi A8L। সেকেন্ড হ্যান্ড, একেবারে নতুন কেনার সামর্থ আমার এখনো হয়নি।রাইসা কত বছর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি ডাক্তার হয়েছে । সৌভাগ্যক্রমে ওর প্রথম পোস্টিং টা আমাদের এখানেই হয়ে যায় । তবে আমার ছন্নছাড়া ভাবটা একেবারেই যায়নি । অফিসে আমি যাই না বললেই চলে, ও ব্যাপারটা আমার টিম মেম্বাররাই হ্যান্ডেল করে। আমি মাঝে মাঝে রাত একটা দেড়টার দিকে অফিসে গিয়ে দেখি প্রজেক্টের কতদূর কি অবস্থা কি বিষয়-আশয়। রাইসা অধিকাংশ সময় হাসপাতলে থাকে ও এই ব্যাপারগুলো খেয়াল খুব কমই করে। আমিও কাজগুলো এমন ভাবেই করি যেন ওর নজরে না পড়ে ।আর নজরে পড়লেও আমাকে বাধা দিবে না তা আমি জানি, কিন্তু দুশ্চিন্তায় থাকবে ওকে দুশ্চিন্তায় রাখতে আমার ভালো লাগেনা, আর শুধুমাত্র রাত দুইটা আড়াইটার দিকে পুরো ঢাকা শহর টহল দিয়ে বেড়ানোর জন্য তো নয়ই । ঢাকার অধিকাংশ থানার পুলিশই আমাকে সেভাবেই চিনে ফেলেছে, রাতে মাঝে মাঝে তাদের সাথে বসেও চায়ের আড্ডা দেওয়া হয়। তো যাক সেসব কথা এখন আসল ঘটনায় আসা যাক,


আমার এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড দেখে এলাকায় একটা কথা রটেছে যে আমার সাথে নাকি জ্বীন আছে। আর এই বিশেষ কারিশমার বিষয়টা রটানোর ক্ষেত্রে আমাদের বাসার কাজের খালাম্মার বেশ বড় হাত রয়েছে। অবশ্য তাকেও দোষ দেওয়া যায় না, একটু একটু সাবেকি আমলের মানুষ তো তাই অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই তার সাথে অদ্ভুত কিছু একটা সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এই ঘটনার শুত্রপাত হয়েছিল মাস তিনেক আগে। একদিন কম্পিউটারে বসে ARMA 3 গেমটা খেলছিলাম, রাইসা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কিছু একটা পড়ছিলো আর খালা ঘর পরিষ্কার করতে করতে সে আরেকটা যে বাসায় কাজ করতো সেই বাসার বাচ্চাকে তাকে নিয়ে একটা কথা বলছিল । প্রথমে আপনাদের সে বাসাটার একটা বর্ণনা দেই, না হলে ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পারবেন না । বাসাটা একটা ছয় তলা ভবন, সেখানে বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট রয়েছে, কিন্তু ভুক্তভোগীর যে ফ্ল্যাটটা সেটাতে যেতে হলে একটা লম্বা করিডর পার হয়ে তারপর সবচেয়ে শেষে যে ফ্ল্যাটটা পরে সেটাই তাদের বাসা । করিডরটা রাতের বেলায় এতটাই অন্ধকার থাকে যে নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায় না। মহিলার হাজবেন্ড একজন ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। নতুন সংসার একটা বাচ্চা হয়েছে, ৪-৫ মাস বয়স। ঘটনাটা এই বাচ্চাটাকে নিয়ে। মহিলার হাজবেন্ড কাজের খাতিরে সন্ধ্যাবেলায় বাসার বাইরেই থাকে। আর ঘটনাটা শুরু হয় ঠিক সন্ধার পরেই, মাগরিবের আজানের পরে । বাচ্চাটা কোন একটা অদৃশ্য বস্তুর দিকে তাকিয়ে একটা না চিৎকার করে কাঁদতে থাকে । এই ঘটনাটাই খালা আমাদেরকে বলছিল আর কাজ করছিলো। তখন আমি এক বাড়িয়ে বললাম আমাকে একদিন ওই বাসায় নিয়ে যাবেন ? রাইসা বলে উঠলো যে তোমার ওখানে কি কাজ, তুমি কি করবে ওখানে গিয়ে?

আমি বললাম দেখি না সমস্যাটা সমাধান করা যায় কিনা, বাচ্চাটা আসলে কি দেখে কাঁদে কেন কাঁদে ব্যাপারটা আমার মধ্যে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিচ্ছে । আর কৌতুহল না মেটা পর্যন্ত যে আমার স্বস্তি হয় না সেটা তুমি ভালো করেই জানো। 

রাইসা বললো যা করবে করো কিন্তু নতুন করে কোন ঝামেলার উৎপত্তি আমি চাইনা। 

আমি রাইসা কে বললাম যে না আমি যে জাস্ট জায়গাটা দেখব, আর যদি কোন সমাধানের পথ থাকে তাহলে সেটা সমাধান করবো ।

খালা এই ব্যাপারটা নিয়ে ওই ভাষার মহিলার সাথে কথা বললেন। উনি আমাকে একদিন আমন্ত্রণ করলেন মাগরিবের আযানের কিছুটা আগে, যাতে আমি ব্যাপারটা দেখতে পারি। উনার হাজবেন্ড তো সেদিন ছিল বাসায়। 

আমি মাগরিবের আযানের আধা ঘন্টা আগে তাদের বাসায় গিয়ে পৌছালাম । তারা তারা আমাকে চা নাস্তা দিল, তো চা নাস্তা খেতে খেতে গল্প করতে করতেই মাগরিবের আজান হয়ে গেল । এতক্ষণ সব ঠিকঠাক ছিল কিন্তু আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম একটা জিনিস দেখে যেই নাম মাগরিবের আযান হলো বাচ্চাটা ঠিক ছাদের একটা কর্নারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো । সেই অদ্ভুত কান্না তার বাবা মা কেউই থামাতে পারছিল না । আমি নিয়মিত নামাজ না পড়লেও আল্লাহর প্রতি আমার ভরসা অত্যন্ত শক্ত এবং আমি নিজেকে আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা হিসেবেই মনে করি। আমি আয়াতুল কুরসি পড়ে বাচ্চাটার বুকে ফু দিলাম, আপনারা বিশ্বাস করবেন না আয়াতুল কুরসি দোয়া টা একেবারে বিদ্যুতের মত কাজ করে, এবং এক্ষেত্রেও করলো । বাচ্চার কান্না সাথে সাথেই থেমে গেল ।

বাচ্চার মা আমাকে জিজ্ঞেস করল ভাই কি দুয়া করলেন আপনি কি দোয়াটা আমাকে লিখে দিয়ে যেতে পারবেন ? আমি বললাম কেন নয় আমি লিখে দিয়ে আসলাম আয়ত-উল-কুরসি । তারপর থেকে বাচ্চাটা কোনদিনই আর সেই সন্ধ্যা বেলায় মাগরিবের আযানের পর কাঁদেনি । সাবেকি আমলের লোকের মধ্যে একটা বিশেষ গুন আছে এরা তিলকে তাল করতে বেশ পটু । সে থেকে এলাকায় ঘটে গেল আমি নাকি জ্বীন-ভূত তাড়াতে পারি তাড়াতে পারি। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সেরকম নয় । এখানে আল্লাহ বান্দাকে সাহায্য করেছেন মাত্র । তো এখান থেকে আমার সেই বিশেষ নাম ডাকের শুরু । তো এভাবেই চলছিলো দিনকাল। 


কিন্তু এসব বিষয়-বস্তু খুবই খারাপ হয়। এসব নিয়ে নাড়াচাড়া না করাটাই ভালো, কারণ কখন, কিভাবে ও কোন জিনিস থেকে যে কোন ছায়া আপনার অজান্তেই আপনার সাথে লেগে যাবে তা আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না। আর এর থেকে মুক্তি পাওয়াটাও বেশ কঠিন, কারন অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সুত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে সেটাই খুজে বের করা যায়না। আর খুজে না পাওয়াগেলে সেটাকে, সে ছায়াকে কেবল সাময়িক ভাবে অতি দূর্বল অদৃশ্য বাধনে আটকে রাখা যায়। শিকড় খেকে উপড়ানো যায় না। এই বাধন যে কোন সময় যে কোন কারণে ছিড়ে যেতে পারে। অনেক হলো ওঝা/তান্ত্রিক টাইপ কথা বার্তা। আমি ওঝাও না, তান্ত্রিকও না বা এসব বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখা কোন ব্যাক্তিও না। আমি একজন Ex Army Officer আর বর্তমানে MERN stack developer সহজ ভাষায় ওয়েবসইট, সফটওয়্যার বিষয়ক বিষয়-বস্তু নিয়ে আমার কাজকর্ম। আর  NIHAR Technologies নামক একটা আই.টি ফার্মের প্রতিষ্ঠতা।


আমার কর্মক্ষেত্র ও এসব আধ্যাত্মিক বিষয় বস্তু সম্পূর্ণ দুই মেরুর দুটি বিষয়। ওই বিশেষ অনুভুতিটা সেন্স করতে না পারলে হয়তো এসবনিয়ে কখনো ভাবতামও না। কিন্তু আমাকে নিয়ে আল্লাহ্’র পরিকল্পনা অন্যরকম ছিলো, নাহলে এখন যে ঘটনাটা আপনাদের বলতে যাচ্ছি এটার সম্মুখীন আমরা হতাম না। আমরা লিখলাম এই কারনে যে, এই ঘটনার সাথে রাইসা ও জড়িত…


তো আসল ঘটনায় আশা যাক,

২১ মে’র রাত প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি, ভয়াবহ অবস্থা । এরকম ঝড়বৃষ্টি শেষ কবে কোথায় দেখছি মনে পড়ছেনা। রাত ১১.৩০ মতো বাজে । অনেক আগেই রাইসার হাসপাতাল থেকে চলে আশার কথা ওর দিনে ডিউটি ছিলো । যদিও ডিউটির পর ও প্রায় সব প্রতিদিনই হাসপাতালের লাইব্রেরীতে আড়াই-তিন ঘন্টা বইপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করে পরবর্তী কোন কোর্সের প্রিপারেশনের জন্য। তারপরেও দিনের শিফটে ডিউটি থাকলে ওর বাসায় ফিরতে সর্বোচ্চ রাত ৮টা- সাড়ে আটটা বাজে। আমাদের গাড়ি একটাই এবং আমাদের ড্রাইভার নেই। আগে আমিই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম আবার নিয়ে আসতাম পরে ওই বলতো প্রতিদিন নিয়ে আসতে হবেনা ও একাই চলে আসতে পারবে। তার পরেও আমি ওকে নিয়ে আসতে যেতাম কিন্তু প্রতিদিন না। আমার সাধারনত তেমন কোন কাজ থাকেনা আর ওর হাসপাতালের এরিয়াটাও বেশ সুন্দর । আমি প্রায়দিনই ওদের হাসপাতালের একটা পুকর পাড়ে বসে সিগারেট ফুকতাম আর চিন্তা করতাম, এখন কি চিন্তা করতাম সেটা জানতে চেয়ে লজ্জা দিবেন না। আমার চিন্তা ভাবনার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তো যেদিন ওই পুকর পাড়ে যেতাম সেদিন ওকে সাথে নিয়েই আসতাম। 

ও একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি ওই পুকুরের অপর পাশেই হাসপাতালের মর্গ। আর আমার ওই পুকুর পাড়ে বসে থাকার এটাও একটা কারন। প্রায়ই পাটিতে পেচানো লাশ আসতো মর্গে, কোনটার অবস্থা ভালো আবার কোনটার অবস্থা এতটাই বিদঘুটে যে লাশবাহী ভ্যান চালকও দূর্গন্ধে নাক-মুখে কষে গামছা বেধে লাশ নিয়ে কোন মতে লাশ ফেলে পালিয়ে বাঁচে ।

তো এখানে আমার বসে থাকা নিয়েও একটা গন্ডগোল বেধেছিলো, বাঁধারই কথা। প্রায়ই যদি এরকম একটা পরিবেশে একটা গাড়ি দাড় করিয়ে কারণ ছাঢ়া একটা লোক বসে বসে সিগারেট ফুঁকে তাহলে যে কারোর মনেই প্রশ্ন জগাটা স্বাভাবিক। 

মুলত গন্ডোগোলের টপিক হলো, সাধারন মানুষের ধারনা হয়েছিল যে আমি হয় লাশের অঙ্গ-প্রতঙ্গের অথবা কঙ্কালের স্মাগলার। কিন্তু অভিযোগ টা ধোপে টিকেনি, কারণ ওই মর্গ থেকে আমার থাকা কালীন সময়ে কখনো না লাশ মিসিং হয়েছে, না কখনো মিসিং হয়েছে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তারপরেও একদিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহাপরিচালক একদিন আমাকে ডেকে আমার উদ্দেশ্য বিধেয় জানতে চেয়েছিলেন। সেদিন উনার সাথে কফি পান করতে করতেই আমার ওই বিষেশ অনুভুতির বিষয়টা উনাকে বলেছিলাম, আমি জানি লোকটা আমার কথা খুব একটা বিশ্বাস করেনি তবে ব্যাপারটা তার কাছে ইন্টারেস্টিং লেগেছে সেটা বুঝতে পেরেছি কারণ এর পরে তিনি দু-তিন দিন আমাকে উনার অফিসে ডেকেছেন, এবং ওই দিন গুলোতে কোননা কোন বিদঘুটে লাশ এসেছে এবং আমাকে কফির দাওয়াতের অযুহাতে আমার অনুভুতির কথা জানতে চাইতেন। উনি আমকে এটাও বলে রেখেছেন যে এর পরে আমি অমন কোন সাইটে গেলে যেন উনাকে নিয়ে যাই । 


তো আমার এখন মুল চিন্তার বিষয় হলো রাইসা এখনো বাসায় ফেরেনি কেন, যদি আজকে আবহওয়া খুবই খারাপ কিন্তু ঢাকার মতো একটা জায়গায় সেটা তেমন আহামরি কোন বিষয় না। একটা উবার কল করলে এরা ঝড়-তুফান-সাইক্লোন-মহামারির মধ্যেও ঠিকই চলে আসবে তবে সেটা বিষয় না। আবহাওয়ার অবস্থা দেখে আমারই উচিত ছিলো ওকে আনতে বেরিয়ে যাওয়া কিন্তু আমার একটা প্রোজেক্টের ভেলিভারি আগামীকাল। সমস্ত কাজ জুনিয়র ডেভলপাররাই করে রেখেছে এখন আমার কাজ হলো সেগুলো রিভিউ ও টেষ্ট করা আর কোন সমস্যা বেরিয়ে পড়লে সেটা সমাধান করা। তো ওই কাজের ভিতরে আমি এতটাই ঢুকে গিয়েছিলাম যে আবহাওয়ার ব্যাপার টা আমি একবারেই খেয়াল করিনি, তার ওপর আমাদের ফ্ল্যাটটা সাউন্ড প্রুফ করে নিয়েছি। বাইরে থেকে শব্দ ভেতরে আসেনা! রাইসার ফোনটাও বন্ধ। কি করবো না করবো ভাবতে ভাবতেই ১২ টা ২০ বেজে গিয়েছে । আপনারা ভাবছেন আমি এখনো কেন বেরিয়ে পড়িনি? 

তার উত্তর হচ্ছে দেখাগেলো আমি ওকে আনতে বেরিয়ে পড়লাম আর ওদিকে ও হয়তো উবার নিয়ে বাড়ির পথে। তবে এখন আর সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার সময় নেই। গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়ে বুঝতে পারলাম আবহাওয়া ঘর থেকে যতোটা খারাপ মনে হচ্ছিলো সেটা তার তুলনায় আরো ভয়াবহ খারাপ। এক একটা বজ্রপাত দেখে মনে হচ্ছিলো আকাশটা বুঝি মাথায় ভেঙে পড়বে! রাস্তা ফাঁকা, তাই আমিও ঝড়ের বেগে আমার পাগলা ঘোড়া ছুটালাম।

তবে যে আলাদা বিষয়টা খেয়াল করলাম সেটা হলো ঘাড়ের কাছে সেই গরম অস্বস্তিকর অনুভুতিটা, তবে অন্যান্য দিনের অনুভুতির থেকে আজকের অনুভুতিটার পার্থক্য হলো যে আজ যেন সেই ঘন অন্ধকার ছায়া কিছু একটা করতে পেরেছে অথবা সে তার কাঙ্খিত সফলতার খুব কাছাকাছি। তবে আমার এখন মুল চিন্তা হলো রাইসা কোথায় ?


আমি গাড়িটা হাসপাতালের সামনে পার্ক করে সরাসরি গেলাম লাইব্রেরীতে। না, এখানে এই দুর্যোগের রাত ১ টার কাছাকাছি সময় কেউ নেই। লাইব্রেরী রুম তালা দেওয়া। 

তো বেরিয়ে যখন ইমারজেন্সির দিকে হাটা দিয়েছি তখন দেখা হলো এক ইন্টার্ণ চিকিৎসক ডাঃ তুহিনের সাথে। এই ছেলেটা আমার পরিচিত, ওই মর্গের পুকুরপাড়ে বসে থাকার সময়ই কোন এক দিন তার সাথে আমার পরিচয় হয়। এই ছেলেটা আমার মতোই একটু অদ্ভুত কিসিমের। ঠিক কিরকম অদ্ভুত তা লিখে প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। ওকেই প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম যে রাইসা কে দেখেছে নাকি ? ও বললো না ভাই, দিনে একবার দেখেছিলাম।

আমি এর সাথে কথা না বাড়িয়ে ইমরিজেন্সির দিকে গেলাম। আসলে সরকারী হাসপাতাল সম্পর্কে আমার জ্ঞান আর পাঁচটা সাধারন মানুষের থেকেও সীমিত। আমার বাবা একজন সেনা কর্মকর্তা আর আমি নিজেও একজন এক্স ক্যাপ্টেন (আর্মি) হওয়ার সুবাদে হাসপাতাল বলতে আমি বুঝি সি.এম.এইচ Combined Military Hospital (CMH)। ওখানকার সবকিছু খুবই অর্গানাইজড। সরকারী হাসপাতাল গুলো এরকম না, কোথায় কি তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আবার কারো কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নিবো ? এখানকার স্টাফরা তেমন আন্তরিক না।


তো ইমারজেন্সি তে যাওয়ার পথে হাসপাতালের মর্গের ডোম এর সাথে দেখা। আমাকে দেখেই বললো,


  • আপনি এখন এই ঝড়-তুফানের এতো রাতে এখানে ভাই ?

আমি - আপনার ভাবীকে দেখেছেন ? আর এতা রাতে আপনিই বা এখানে কি করছেন ?

  • আর বইলেন না ভাই। সন্ধ্যার দিকে একটা মহিলার লাশ আসছে, এক্কবারে বিতিকিচ্ছর অবস্থা আর সেটা নিয়ে নিয়েই পড়ছি ঝামেলায়, আর কাটাকাটির সময় ম্যাডাম (রাইসা) ওখানেই ছিলেন।

আমি - আপনি কি মর্গে তালা লাগিয়ে এসছেন ?

  • জ্বী ভাই।

আমি - তালা দেয়ার আগে ভেতরে আর কেউ আছে নাকি ভালো ভাবে চেক করেছেন ?

  • কি আর করমু ভাই কন, এই কাটাকুটির কাজের মধ্যই কারেন্ট গেছেগা, তাই তো তালা দিয়া আসলাম বিড়ি নিতে। আর যখন আমি তালা দিয়া আসছি তখন ওইখানে আমি আর ওই লাশ ছাড়া আর কেউ আছিলোনা। তয় আইজ রাইতে আর কারেন্ট আইবো বলে মনে হয়না ।

আমি- কি বলেন হাসপাতালে সারা রাত কারেন্ট থাকবেনা এটা কিভাবে সম্ভব ?

  • হাসপাতালের মতো সুবিধা তো আর মর্গে নাই ।

আমি ভালোই বুঝতে পারলাম এই লোক ভিতরে রাইসা আছে কিনা তা না দেখেই তালা লাগিয়ে দিয়ে বিড়ি কিনতে চলে এসেছে। আসারই কথা, কারন এত রাতে রাইসার ও আসলেই ওখানে থাকার কথা না ।

আমি উনাকে বললাম - সিগারেট আমার কাছে আছে । আপনি আমার সাথে আসেন ।

উনি আমার গাড়িতে উঠতে ইতস্থত বোধ করছিলেন, কারণ উনার পোশাকটা নোংরা আমিই উনাকে বললাম আরে ভাই উঠেনতো। গাড়িতে উঠেই আমি একটা সিগারেট ধরালাম আর উনাকে একটা দিলাম । আমার এই মানসিক উত্তেজনা সহ্য হচ্ছে না, নিকোটিন দরকার। আর এই লোক নিজেও জানেনা যে সে কি ভুল করে এসেছে ।

সরাসরি মর্গের গেইটে একবারে সামনে এসে গাড়িটা এমন ভাবে দাড় করালাম যেন গাড়ির হেডলাইট সরাসরি মর্গের গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তবে একটা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভিতরে একটা টিমিটিমে আলো জ্বলছে, যেটা দেখে ডোম মহাশয় একটা ডোক গিলে বললেন।

  • ভাই মর্গের ভিতরে এমন কোন বাত্তি নাই। আইজকা যাইগা চলেন । এখানে কত কিছু হয় আপনিতো জানেন না !

আমি- আপনি আমাকে চাবি দেন। আপনাকে ভেতরে যেতে হবেনা।

উনি আমাকে চাবিটা দিলেন, যদিও উনার আসার কোন ইচ্ছাই নেই কিন্তু কৌতুহল খুব খারাপ জিনিস। এই কৌতুহলই উনাকে আমার পিছু পিছু আসতে বাধ্য করলো। আমার আমি একবার ভেবে ছিলাম গাড়িতে রাখা লোহার রডটা সাথে নিয়ে আসি। তবে সম্ভাব্য যে শক্তির, না যে তরঙ্গের মুখোমুখি আমি হতে যাচ্ছি তা এই পার্থিব লোহার রডের উর্ধে। কাঁধের কাছে আর বুকের দুই পাজরে সেই তীব্র গরম অনুভুতিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে । তবে আমি জানি এর বেশি এরা কিছুই করতে পারবেনা। এসব নিয়েই ঘাটাঘাটি করি, আর এটা করতে করতে আমার নার্ভ শক্ত হয়ে গিয়েছে।

এইযে কিছুদিন আগের কথাই ধরুন না, চট্টগ্রাম গিয়ে ছিলাম। একটা কন্টেইনার ডিপো তে, হ্যা ওইযে বিশাল অগ্নি দূর্ঘটনার শিকার কন্টেইনার ডিপোতে। তখনো ওই ধ্বংসস্তুপ এর কিছু জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। তবে উদ্ধারের কার্যক্রম অফিসিয়ালি স্থগিত ঘোষনা করা হয়েছে। তখন রাত আড়াইটা। চারেদিকে কেমিকেলের ঝাঁঝালো গন্ধ আর সাথে আমার বেড়ে চলা তীব্র অস্বস্তিকর অনুভুতি। আমি সেদিন ইচ্ছা করেই আমার জাতিসংঘের লোগো ওয়ালা গেঞ্জিটা আর সখ করে কেনা লাইসেন্স করা ওয়াকিটকিটা নিয়ে গিয়েছিলাম।

ওখানে পুলিশ পাহারা থাকার কথা থাকলেও ছিলো কয়েকজন আনসার সদস্য, পুলিশও হয়তো ছিলো কিন্ত ওই স্পটে না। তো আমার বেশভূষা বেশ কনফিউজিং ছিলো ওই আনসার সদস্যদের কাছে। ডিপোতে ঢোকার প্রবেশদ্বার পুলিশি ডু নট ক্রস লেখা সংবলিত টেপ দিয়ে রেসট্রিকটেড করা ছিলো। আমার গাড়ি ওই প্রবেশদ্বারে দাড় করাতেই একজন একজন আনসার সদস্য এগিয়ে আসলেন । আমি গাড়ির কাঁচ নামাতেই বললেন,

  • আপনি কে, এদিকে কই জান, দেখেন না প্রবেশ নিষেধ ?

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রাখা ওয়াকিটকিতে টিউন করে রাখা কোন একটা ফ্রিকোয়েন্সি থেকে একটা অস্পষ্ট রেডিও সাউন্ড আসলো আর সাথে সাথেই আনসার সদস্য স্যালুট দিয়ে বললো,

  • সরি স্যার ।

আমি বললাম ঠিক আছে, এই টেপ টা উচু করো আমি ভেতরে যাবো এবং সে সাথে সাথেই তাই করলো আর আমি গাড়ি নিয়েই ভেতরে চলে গেলাম। ভেতরে আগুনের তাপে...

পরবর্তী পর্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ