অনুভূতি - ২ (পর্ব-১০ ও শেষ পর্ব)




 


আমি- ইমারজেন্সি থেকে অফিসার্স ফ্যামিলি ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছি।

-আমাকে ইন্টারোগেশন করা বাদ দিয়ে, ওর কাছে যাও।

আমি- কি যে বলেন স্যার, আসালামুআলাইকুম।


আমি বুঝতে পারলাম এম.পি ইউনিটের লোকজন কেন কিছুই রেকর্ড করেনি। আর কেনই বা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের রাস্তা ফাঁকা ছিলো!


তো ফারজানাকে নিয়ে রুমে ঢোকার পর,


রাইসা- সি.এম. এইচে নিয়ে আসলে যে, তাও অফিসার্স ওয়ার্ডের কেবিনে। বাবার পরিচয়ে সি.এম. এইচে চিকিৎসা পাওয়ার বয়স তো আমার পার হয়ে গিয়েছে ? তুমিতো উবার ড্রাইভার, না? দিয়া ফাইলটা দাও তো।


আমি বুঝলাম যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে,


দিয়া ফাইল দেওয়ার পর রাইসা রোগীর পরিচয় যে অংশটাতে লেখা থাকে সেটা পড়তে শুরু করলো,


রোগীর নাম রাইসা, ওয়াইফ অফ মেজর এনাম, ইউনিট ডি.জে.এফ.আই। এটুকু পড়ে আমার দিকে তাকালো। শুধু ও না। ফারজানা বাদে সবাই। অন্যরা বরং সিরিয়াস ভাবে তাকালো। কারণ এই পরিচয়টা ফারজানা জানতো।

ফারজানা আমার কানের কাছে এসে বললো ভাবি এটা জানতো না?

আমি- তো কি মনে হচ্ছে, এই রুমের কেউ এটা জানতো?


তখন সবার দিকে খেয়াল করতে গিয়ে দুজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে দেখে সাথে সাথে স্যালুট দিলো। 


রাইসার বাবা আমার বাবাকে বললেন,


-দেখেন আমাদের আরেক মেয়ের কান্ড। এই মেয়ে আমরা এখানে কেউ ড্রেসে আছি ইভেন তুমি নিজেও তো  সিভিল ড্রেসে।


ফারজানা- স্যার, প্রোটক..


আমার বাবা প্রোটকলের কথা রাখো, (আমাকে ইসারা করে) এই গাধাটা কি প্রোটকল জানেনা? আর নিজে আজ কয়টা প্রোটকল ভেঙেছে জিজ্ঞেস করো তোমর বন্ধুকে।


রাইসা বেড থেকেই বললো বাবা আমি এখানে আছি কিন্তু, (ওর বাবা-মার দিকে তাকিয়ে) চার বছর আগে ওকে কেউ অপমান করেছিলো আর একজন সেদিন সেটার কোন প্রতিবাদ করেনি। চার বছর আমি আমার বাড়িতে যাইনি। যখন ওই রেস্তরায় গিয়েছিলাম, আমার মনে হলো আমার বাবা-মা’র সাথেতো আমি ঠিকই দেখা করছি কিন্তু ও? আর আমাদের ছেলে-মেয়ে হলে ওরা ওদের দাদার বাড়ি নানার বাড়ি কিছুই দেখবেনা। দিয়া তো আমার পরিবারের সমস্যাটা একরকম সমাধান করেই ফেলেছিলো যদিনা আমি অসুস্থ হতাম। আর বাবা (আমার আব্বু) আপনি ওকে অপছন্দ করতেন কারন ও আপনার কাছ থেকে টাকা নিতো, মিথ্যা বলেও নিতো ওর কোন কিছুই আপনার ছোট ছেলের মতো পরিষ্কার ছিলোনা ও আপনার নিকট ছিলো একটা ঘোলা কাাঁচের মতো ওর জন্য আপনাকে অপমানতিও হতে হয়েছে বহুবার। আসলে বাবা ও এমনই, সব সময় নিজের আশে-পাশে একটা দূর্ভেদ্য ধোঁয়াশা তৈরী করে রাখে। এটা ওর একটা বৈশিষ্ট এইযে, দেখুন এতো বড়ো কথাটা আমার কাছথেকে লুকিয়ে রেখেছিলো, অধিকাংশ রাতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় কেন যায় কোথায় যায় আমি কিছুই জানিনা আর জানার চেষ্টাও করিনি কারণ বিশ্বাস। ও মাঝে মাঝে বলে ওর বন্ধুর সাথে দেখা করতে যায় কিন্তু আমি জানি ওর তেমন কোন বন্ধু ঢাকার বাইরে নেই আর থাকলেও তাদের সাথে রাতে দেখা করতে যাওয়ার কথা না তাইনা? আর মা ওর মনে করে আপনাদের কাছে ওর কোন মুল্য নেই। একটা সময় ছিলো যখন ও ফোন করলে, বাড়িতে গেলে ওর ধারণা আপনি বিরক্ত হন। আপনারা চান না ও আসুক তার পেছনে কারণও আছে যেমন ও গেলে ওর ফিরে আসার পর আপনাকে ওর সম্পর্কে নানা ধরনের অভিযোগ শুনতে হতো। আমাকেও শুনতে হয়। একটা ব্যাপার কি জানেন ওর বিরুদ্ধে খালি অভিযোগই আছে প্রমান নেই। আপনাদের সময় হয়তো কিছু বাজে অভ্যাস ছিলো এখন নেই, আমি ওর জীবনে আসার পর থেকে নেই। শুন্য স্থান থাকলে সেটা কিছুনা কিছুতো পুরো করে নিবেই তাইনা? আমি চাই আজ এই সব কিছুর শেষ হোক।


আমার মা রাইসাকে জড়িয়ে ধরলো দুজনেই কাঁদছে। আর ওর মা এসেে আমাকে বললো,

  • এই ছেলে শোনো।

আমি- জ্বী আন্টি?


রাইসার মা বললেন, আমি জানতাম তুমি আন্টিই বলবে। আমি তোমর আন্টি হই? 

আমি- সরি, মা।

রাইসার মা- এখন থেকে এটাই বলবে।

আমি- জ্বী।

তারপর আমাকে বললেন রাইসা হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেলে সবাইকে আমার বাসায় নিয়ে আসবে, ফারজানাকে বলেন এই মেয়ে তুমিও।

ফারজানা- জ্বী ম্যাডাম।


রাইসার মা- কি?

ফারজানা- সরি, জ্বী আন্টি।


তারপর দিয়া বললো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তাহলে আজ আমারা সবাই বাসায় যাই। ফারজানাও বললো সিরিয়াস কিছুতো না, শুধু এনাম থাকলেই চলবে। আমিও বাসায় যাবো। আমার ছেলেটা অপেক্ষা করছে। আমিও সবাইকে বাসায় যেতে বললাম আর আমার বাবাকে বললাম। দিয়াকে এতো রাতে একলা কিভাবে যাবে? ও এখানেই থাক আমি ওর বাবার সাথে কথা বলে নিবো। 


রাইসার মা বললো দিয়া এখানে কোথায় থাকবে, ওকে বরং আমি আমাদের বাসায় নিয়ে গেলাম এটাতো আমার অরেকটা মেয়ে। দিয়া কিছু বলতে যাবে.. তখন আমি বললাম,

-একদম চুপ, নাহলে পিছনে আবার ভুত ছেড়ে দিবো।

রাইসাও বললো যাহ্ না, আমার বাসা মানেই তোর বাসা আর বড় বোনের কথা শুনতে হয়। 

দিয়া- আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু পরের বার কিন্তু এরকম কারনে হাসপাতালে আসবো না, খালামনি বানাবা যখন তখন আসবো।


কথাটা বলেই ফিক করে হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। পাঁজি মেয়ে একটা। আর এটা নিয়ে সবাই হাসছে।


সবাই যাওয়ার পর রাইসার পাশে গিয়ে বসলাম।


রাইসা হাতটা জড়িয়ে ধরলো। আজ হঠাৎ করে সবকিছু কিভাবে ঠিক হয়ে গেলো তাইনা?


আমি- নিজে থেকে ঠিক হলো কই, তুমিই তো ঠিক করলে।

রাইসা- আমি ঠিক করলাম?


আমি- অবশ্যই।

রাইসা- আচ্ছা বাদ দাও।

আমি- এখন কেমন লাগছে?

রাইসা- ভালো। অনেকটাই ভালো।


আমি- কিছু খেতে ইচ্চে করছে? কিছু খাবা?

রাইসা- এতো রাতে খাবার কোথায় পাবা?


আমি- তুমি কি খাবা বলো? ম্যানেজ করার দ্বায়িত্ব আমার।

রাইসা- ওর স্যালাইন লাগানো হাতটা তুলে মিস্টি করে হেসে বললো আমি জানি তুমি পারবে। কিন্তু স্যালাইন লাগানো অবস্থায় খেতে পারবোন। তুমি তোমার খাওয়ার ব্যাবস্থা করো।


আমি-নাহ্, স্যালাইন শেষ হোক। এক সাথে খাবো। একলা একলা আমি খেতে পারবোনা।

রাইসা- কাঁদছো কেন। আমার কিছু হয়নিতো।


আসলে রাইসাকে এর আগে হাসপাতালে অনেক দেখেছি কিন্তু এভাবে হাসপাতালের বেডে না। আমি কাঁদতে পারিনা কিন্তু আজকে আবার, কিভাবে কি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিনা।


রাইসা- আমি একটা গিফট চাই।

আমি- কি?


রাইসা- একটা মেয়ে বাবু।

আমি- আচ্ছা আমি ম্যানেজ করছি, Wait !!! কি ? মানে, আ..আমাদের বাচ্চা ??

রাইসা মাথা নেড়ে বললো হুমম।


আমি- আর তোমার পড়াশোনা?

রাইসা- এই জন্য তুমি এতোদিন !? তোমাকে কি যে বলবো ! বাচ্চা থাকলে পড়াশোনা হবে না তোমাকে কে বলেছে ? তোমার বান্ধবী মেজর ফারজানার ছেলে আছে তার ক্যারিয়ার কি থেমে গিয়েছে? তাছাড়া আমার প্রত্যেকটা বান্ধবীরই ছেলে মেয়ে আছে এক জনের তো দুজন আছে। আর তুমি মেয়ের নামে কোম্পানি খুলে বসে আছো কিন্তু মেয়ে কই ?


কথাগুলো বলতে বলতে রাইসা উঠে বসলো, আর আমি ওকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলাম বললা হবে, এবার হবে।


রাইসা- এই কি করছো? এখনই ? 

আমি- কেন নিজের বৌকে জড়িয়ে ধরা যাবেনা? ওহ্ তুমি কি মনে করেছিলে, মানে..!?! বলেই হাসতে শুরু করলাম। 

রাইসা- আস্তে হাসো, হাসপাতালে কেউ এবাবে হাসে?


আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে ওর খুব কাছ গিয়ে বললাম আচ্ছা যদি মেয়ে বাবু না হয়ে ছেলে হয়। ও আরো কাছে এসে বললো তাহলে আরেকটা বাবু নিবো।


আমি-আচ্ছা নিবো, তুমি অসুস্থ রেস্ট নাও।

রাইসা- আমি অসুস্থ না, সামান্য দূর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। আজ সারা রাত গল্প করবো।


আমি ওকে শুইয়ে দিয়ে বললাম, গল্পতো শুয়ে শুয়েও করা যায়, বলে হাটু মুড়ে ওর বেডের পাশে বসে ওর হাতটা ধরে গল্প করতে করতে কথন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ভোর বেলায় ফারজানা কখন যে রুমে এসেছে তা ঘুমিয়ে থাকার কারনে আমি খেয়াল করিনি, তবে রাইসা জেগেই ছিলো।


ফারজানা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো এই এনাম ওঠ। ভাবিকে বসায় নিয়ে গিয়ে খেয়াল রাখিস। আর সারা রাত এভাবেই ভাবির হাত ধরে হাটু মুড়ে পড়েছিলি এখানে, তুই পারিস ও। বলতে বলতে ও রাইসার হাতের স্যালাইনের লাইনটা খুলে নিলো। আর বললো,


-ভাবীর ক্ষুধা লাগার কথা, চল ক্যাফেটোরিয়ায় যাই। আমিও নাস্তা না করেই এসেছি। আজ খেতে খেতে তোদের প্রেমের গল্পটা শুনবো এরই মধ্যে দিয়াও এসেছে। দিয়াও বললো আমিও শুনবো..


আমি তাহলে চলো সবাই, গল্প কিন্তু অনেক লম্বা সময় আছেতো?

ফারজানা- সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা।


এখনো মধ্যে ঢাকায় শীত না পড়লেও হালকা কুয়াশা পড়ছে। ফারজানা আর দিয়া আমাদের একটু সামনে হাটছে, আমি জানি ওরা আমাকে আর রাইসাকে স্পেস দেওয়ার জন্যই কাজটা করছে।


আমি রাইসার হাতটা ধরে হাটছি, সকালও এত সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিলোনা! ক্যাফেটোরিয়া বেশি দুরে না এখন মনে হচ্ছেেএকটু দূরে হলেই ভালো হতো, আরেকটু সময় পেতাম। তবুও যেটুকু সময় পেয়েছি তা অমুল্য…


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ