অনুভূতি - ২ (পর্ব-৮)




 


যেভাবে আগুন ধরেছিলো তাতে আমার দুই হাতের কবজি ভয়ানক ভাবে পুড়ে যাওয়ার কথা কিন্তু পুড়েছে খালি গ্লাভস, হাতের একটা লোমও পোড়েনি!


আমার অক্ষত হাত দেখে ইমাম সাহেব আমাকে প্রশ্ন করলেন- আপনি আসলে কে? সত্য উত্তর দিবেন। রশিদ সাহেব কে দেখে বুঝলাম উনার মনেও এই প্রশ্ন।


আমি- অল্লাহ’র বান্দা।
ইমাম সাহেব- জ্বীনও কিন্তু আল্লাহ’র বান্দা।


আমি আমার ক্ষতটা দেখিয়ে বললাম জ্বীনের কি বি+ গ্রুপের রক্ত থাকে? চলুন ওই পানিটা ফেলতে হবে বলে হাতের সাদা কাগজটা ছিড়তে ছিড়তে গড়ির স্টার্ট বন্ধ করতে গেলাম। তারপর বাড়ির মেইন গেইটের দিকে আমরা এগুতে লাগলাম উনারা দুজনও আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন। মেইন গেইটের কাছে গিয়ে বুঝলাম যে জিনিসটা কি শক্তি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। আমি গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢোকার পর রশিদ সাহেব মেইন গেইটটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। হেভি লোহার মেইন গেইটটা জাস্ট কাগজের মতো দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে। অবশ্য এরকম কিছু হতে পারে সেরকম একটা ধারণা আমার ছিলো গাড়িটা অ্যাঙ্গেল করে পার্ক কারার আরেকটা কার এটা, নাহলে আমার গাড়িটাও যেত!



তো আমরা তিনজন গিয়ে টুকরা করা কাগজ আর পানি সহ ওই পাত্রটা ওই বিল বা নদী যাই হোক তাতে ফেলে দিলাম। এখন আমি সেই শীতল শুভ্র আলোকের অনুভূতিটা বেশ অনুভব করতে পারছি।


আমরা দিয়ার রুমটাতে গেলাম, রাইসা অমাকে জিজ্ঞেস করলো,


নিচে এতো জোরে শব্দ হলো, কি হয়েছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক আছেতো?
আমি- না, মেইন গেইট টা ঠিক নাই। চলো বাসায় যাই, এখানকার কাজ শেষ। আর ইমাম সাহেব, আপনার বাসা কোথায়? আমাদের সাথে গাড়ি আছে, ড্রপ করে দিবো।


রশিদ সাহেব- আর আমরা?
আমি- আপনাদের বাড়ি, আপনারা এখানেই থাকবেন। আর কোন সমস্যা নেই।
রশিদ সাহেব- আপনার হাদিয়া বা ফিস?
আমি- আপনার কি মনে হয়ে আমার আর আপনার মেয়ের দুজনের জীবনের মোট দাম কত হতে পারে ?
রশিদ সাহেব- আমি ঠিক বুঝলাম না!?


আমি- আপনার মনে নেই সিলেটের নেই লোকটা বলেছিলেন “এখানে আপনার মেয়ের এবং আপনার মেয়েকে যে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে উভয়েরই প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে।” বাদ দেন ! তবে এক কাপ চা হলে মন্দ হয়না। 


আর দিয়াকে বললাম, আপনার ওই পেইন্টিংটা। যেটাতে জঙ্গলের মধ্যে আমার আর রাইসার ছবি একেছেন, ছবিটা আমি কিনতে চাই। আপনি যা দাম চাইবেন তাই দিবো।
দিয়া- ও আপনার আর আপুর ওই ছবিটা?
আমি- হুমম।
দিয়া- আপুর কাছে শুনলাম আপুর কোন বোন নেই, শ্যালিকা হিসেবে আমি আপনাকে ওটা গিফট করলাম। আর আপনি তো জবর লোক, জঙ্গলের ওই জায়গাটায় মানে যে জায়গার ছবিটা আমি একেছি ওখানে ওরকম একটা ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ মেরে সামনে নিয়ে বসে ছিলেন? আর মর্গ বা ওই টাইপের আজে বাজে জায়গায় কি করেন আপনি? আর আপনি আমাকে আপনি বলবেন না, বয়সে আমি আপনার ছোট।
(আমি বুঝতে পারলাম রাইসা এর মধ্যেই এই মেয়ের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছে।)


আমি- ওসব জায়গায় আমি কি করি সেটা ব্যাখ্যা করতে গেলে আজ রাতে আর বাড়ি ফেরা হবেনা। অন্য একদিন বলবো। উমি এখন চা বানিয়ে নিয়ে আসো, আর হ্যা চিনি বেশি হবে।


দিয়া সবার জন্যই চা নিয়ে আসলো।


তো চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি, রাইসা আর ইমাম সাহেব বেরিয়ে গেলাম। ইমাম সাহেব কে ড্রপ করার সময় উনি বললেন,
-আপনার ফোন নম্বরটা দেওয়া যাবে?
আমি একটু হেসে নম্বরটা দিয়ে দিলাম।


অনেক রাত হওয়ায় রাস্তা ফাঁকা, আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। রাস্তা ফাঁকা থাকলে আমার গাড়ির স্পিডো মিটারের গেজ ৯০-৯৫ এর নিচে নামেনা। আজ জোরে চালাতে ইচ্ছা করছেনা, একটা গান চালিয়ে দিলাম।


Tu dede mera saath thaam le haath
Chahe jo bhi ho baat,
Tu bas de de mera saath,
Tu bas de de mera saath…


গানটা যে রাইসাকে উদ্দেশ্য করে চালিয়েছি সেটা ও বুঝতে পেরেছে তা ওর আমার দিকে তাকানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাইসা বললো.
আচ্ছা তুমিযে, রাতে ঘুরতে বের হও এরপর থেকে আমাকে সাথে নিবে?
আমি- আর তোমার ডিউটি?
রাইসা- আমার কি রোজ ডিউটি থাকে নাকি?
আমি- নিবো।


বাসায় পৌছে একটা ঘুম দিলাম, বিকালের দিকে রাইসার ডাকে ঘুম ভাঙলো। এবার দুকাপ কফি বানিয়েই নিয়ে এসছে। কফি দিয়ে বললো,


-গতকাল রাতের ওই ছেলেটার কথা মনে আছে?
আমি- কোন ছেলেটা, ও ওই যে কি যেন নাম। হ্যা, রনি। কেন কি হয়েছে ?


রাইসা- রশিদ সাহেব তোমাকে ফোন করেছিলেন, ঘুমিয়েছিলে তাই আমি ফোনটা রিসিভ করেছিলাম। বললেন, ছেলেটাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে রশিদ সাহেবের বাড়ির পাশের বিলে/নদীতে ফেলেদিয়ে গিয়েছে। একদম মর্গের ওই ডেড বডির মতো। পুলিশ সন্দেহ করছে কোন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাজ।
আমি- নৃশংস ভাবে বুঝলাম কিন্তু, মর্গের ওই ডেড বডির মতো সেটা তুমি কিভাবে বুঝলে?


রাইসা- ডেড বডির বর্নণা শুনে।
আমি উনার ওপর একটু বিরক্ত হলাম, উনার রাইসাকে এই বর্নণা দিতে কে বলেছিলো! পরে সরাসরি আমাকে বললেই পারতেন। কিন্তু বিরক্তিটা রাইসার সামনে প্রকাশ করলাম না। আমি বললাম,
-পুলিশের শুধু শুধুই সময় নষ্ট কারার একটা রাস্তা তৈরী হলো।
রাইসা- কেন?


আমি- তোমার কি মনে হয় কোন মানুষের পক্ষে ওভাবে হত্যা করা সম্ভব? হুম, ওইযে রোড রুলার গুলো আছেনা যেগুলো রাস্তা বানানোর আগে মাটি সমান করার জন্য ব্যাবহার করে ওগুলো চলার সময় ভারী চাকা গুলো ভাইব্রেট করে সেগুলো দিয়ে হাড় গুড়ো করা সম্ভব। তবে….


বাদ দাও ওসব। এগুলা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছেনা। আচ্ছা শুনো, কাল-পরশু আবার কক্সবাজার যাবো। গতবার তো আর ঘুরতে যাইনি। এবার শুধু ঘুরতে যাবো।


রাইসার কক্সবাজার যাওয়ার ব্যাপারটা মনে ধরেছে সেটা ওর মুখের মুচকি হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।


তো কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসার পর মাস তিনেক পর একদিন সারা রাত ঢাকা শহর ঘুরে সকাল সাড়ে ছয়টা/সাতটার দিকে বাসায় এসে দেখলাম রাইসা কফি বানাচ্ছে, আমি বললাম একটু বেশি করে বানাতে। আমিও খাবো।
রাইসা কফি নিয়ে বারান্দায় এসে আমাকে দিতে গেল।
আমি- একটু দাড়াও সিগারেট জ্বালাবো।


তো যখন কফি খেতে খেতে রাইসা বললো,
-আজকাল তোমার শখের অডি প্রায়ই ডি.জে.এফ.আই এর হেডকোয়ার্টারের পর্কিং এ দেখা যায় ঘটনা কি বলোতো?
আমি- তুমিকি করে দেখলে? গিয়েছিলে নাকি?


রাইসা- একদিন দেখেছিলাম, এক বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলাম। তখন তোমাকে গাড়ি নিয়ে ওদিকে যেতে দেখেছিলাম আর আজকে আব্বু বললো!
আমি- না তেমন কিছুনা, কিছু কাজ ছিলো।


রাইসা- বাবা আরো বললেন আমাদের দুজনকে উনাদের বাসায় যেতে। কি জানি কি গুরুত্বপূর্ণ দরকার। 


কথাটা বলেই রাইসা চুপ হয়ে গেল। যদিও ওর খুশি হওয়ার কথা ছিলো। হয়নি কেন এর পেছনে একটা কারণ আছে বলি আপনাদের। 


ওর আমার হাত ধরে বাসা থেকে চলে আসার পরিকল্পনা ছিলোনা, যেদিন ওই সাকিব ও তার পরিবার ওকে দেখতে আসার কথা ছিলো সেদিন ও আমাকেও আসতে বলেছিলো। তখন আমার পরিচয় ছিলো….উবার ড্রাইভার বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলাম। ওর মা খুব অপমান করেছিলেন আমাকে, আমার গন্ডারের চামড়া। কিছুই মনে করিনি, কিন্তু রাইসার আত্মসম্মান বোধ খুব সেনসিটিভ। সবার সামনে আমাকে অপমানটা ও সহ্য করতে পারেনি, হাত ধরে তখনই চলে আসে আমার সাথে। ওর বাবা আটকানোর চেষ্টা করেছিলো, রাইসা শোনেনি শুধু বলেছিলো ”আব্বু আমি তোমার মেয়ে” তারপর আর ও আর ওদের বাড়িতে যায়নি। আমি জানি ও আজও যেতে চায়না। আমিও কখনো ওকে জোর করিনা, আজ যদি ও যেতে না চায় আজও জোর করবো না!


আমি রাইসার মন বুঝতে পেরে বললাম, কোন ভাবে উনাকে কোন রেস্তোরাঁতে ডাকলেকি উনি কিছু মনে করবেন?


রাইসা কোন উত্তর দিলোনা।


আমি রাইসাকে বললাম আমি একটু বাইরে থেকে আসছি বলে বাইরে আসলাম। ওর বাবার সাথে ব্যাপারটা ডিসকাস করলাম। লোকটাও মেয়েকে খুব ভালোবাসেন। একটা রেস্তোরাঁর ঠিকানা দিয়ে বললেন আজ সন্ধ্যা ৭ টার সময় যেন রাইসাকে নিয়ে আসি।


ঘুরে এসে রাইসাকে বললাম “ আচ্ছা আমাদেরকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ধানমন্ধির একটা রেস্তোরাঁতে যেতে হবে, তুমি যাবে?”
রাইসা মুচকি হেসে আমাকে বললো- আব্বুর সাথে কথা বলতে বাইরে গিয়েছিলে তাইনা?
আমি- হুমম।


রাইসা- বাইরে না গেলেও হতো। আব্বুকে কথা দিয়ে এসেছো আমাকে নিয়ে যাবে, আমি না গেলে তোমার মুখ থাকবে? যাবো।


আমরা সন্ধ্যার দিকে বেরিয়ে গেলাম ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে, আসলে ওই রাস্তাটা একটা কুফা। দশ মিনিটের রাস্তা পার হতে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। 


জ্যাম ঠেলে রাইসার বাবার দেওয়া ঠিকানায় পৌছালাম, রাইসা সেকেন্ড সিটে বই পড়ছিলো তাই দুইটা জিনিস খেয়াল করেনি, তার মধ্যে একটা হলো আমরা যে পৌছে গিয়েছি সেটা। এটা স্বাভাবিক, কারণ রাস্তায় জ্যামে গাড়ি বার বার দাড়  করাচ্ছিলাম তাই গাড়ি দাড় করালেই মনে করার কোন কারন নেই যে গন্তব্যে চলে এসেছি। যদিও ও বইয়ে মুখগুজে আছে সেটাও একটা কারন আর সেই কারনেই ও দিত্বীয় ব্যপারটা খেয়াল করেনি যে ওর বাবার সাথে ওর মাও এসেছেন।


আমি রাইসাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাক দিলাম। ও আমার দিকে ঘুরতে গিয়ে ওর মাকে দেখলো। একটু তাকিয়ে থেকে আমাকে বললো,
গাড়ি ঘেরাও।


আমি ওর মন বুঝি, তাই কিছু জিজ্ঞাসা করলামনা। তো যখনি গাড়িটা ঘোরাতে যাবো মানে একটু ঘুরিয়েও ফেলেছি তখন ওর বাবা দৌড়ে আমাদের দিকে আসতে লাগলেন। মুরুব্বি মানুষ, তার ওপর রাইসার বাবা। মেয়ের তার বাবার এভাবে দৌড়ে আশার দৃশ্যটা সহ্য হয়নি কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে বললো গাড়ি থামাও। কাজেই ইন্সট্যান্ট ব্রেক।
রাইসা এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আর আমি গাড়ি নিয়ে ফেঁসে গেলাম রাস্তার সামান্য মাঝখানে। আমি গড়িটা আবার রিভার্সে নিয়ে সাইড করে ওদের বাবা-মেয়ের ওই মুহুর্তটা দেখতে লাগলাম। 
দুজনই কাঁদছে, আসলে দীর্ঘদিন পর দেখা তো। ফোনে কথা হলেও আমার হাত ধরে চলে আসার পর রাইসার আর ওর বাবার ফোনে কথা হলেও কখনো দেখা হয়নি। রাইসাই দেখা করেনি। 


এরই মধ্যে ভুল করলো এক গাড়িওয়ালা। ওই যে হর্ণ, কারণ রাইসা আর ওর বাবা রাস্তার সমান্য মাঝখানের দিকে ছিলো। তো একবার হর্ণ দিলেও হতো, শালা দিয়েছে তিনবার তার ওপর ওপর হেডলাইট আছে হাইবিমে।
রাইসা হর্ণ শুনে আর হেডলাইট দেখে বুজতে পেরেছে কি হতে চলেছে, ও আর ওর বাবা আমাকে আটাকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু দেরী হয়ে গিয়েছে। ততক্ষনে আমি গাড়ির কাছে পৌছে গিয়েছি। হেডলাইটে বাড়ি দিতে যাবো তখন একজন পুলিশ সদস্য পাশ থেকে তেড়ে এসে আমাকে ধরে বললো এই মিয়া কি করেন। এই গাড়িওয়ালার কি দোষ? বলে রাইসা আর ওর বাবাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললো। 
এবার আমার সহ্যের সীমা ছড়িয়ে গেল। মাদা৥*#কে রাস্তায় ফেলে মারতে শুরু করলাম। রাইসা আর ওর বাবা আর দুজন পুলিশ সদস্য আমাকে আটকালো।


একজন সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে বললো শালা থানায়… বলতে গিয়ে স্যালুট দিয়ে বললো,
-সরি স্যার আপনি? কি হয়েছে?
আমি- আপনার ওই (গালি দিতে গিয়েও দিলামনা, পাশে রাইসা আর ওর বাবা দাড়িয়ে আছে), ওকে জিজ্ঞেস করেন।


সবটা শুনে সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব ছেলেটাকে বললেন উনাকে চিনিস?


আমি সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের কথা আটকে বললাম, চেনার দরকার নেই। ও আমাকে...

পরবর্তী পর্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ