অনুভূতি - ২ (পর্ব - ২)




 


দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কন্টেইনার, বিশাল বড়ো সেডের ধ্বংসাবশেষ আর কেমিকেল মিশ্রিত পানি ছাড়া কিছুই নাই। না, সেটা বললে ভুল হবে আমি যে জায়গাটাতে এসে গাড়ি দাড় করিয়েছি এখানেই সার্বধিক মানুষের উপস্থিতি ও হতাহত হওয়ার কথা যা সরকারি হিসেবের চেয়ে অনেক বেশিই হবে। সুতরাং এখানকার পনির সাথে মিশ্রিত আছে প্রচন্ড উত্তাপে গলে যাওয়া মানুষের অস্থি-মজ্জাও। যা আমার চামড়ার স্যানডেলের ভেতর প্রবেশ করে তা পিচ্ছিল করে দিচ্ছে। যে যাই বলেন, ব্যাপারটা কিন্তু অস্বস্তি কর।


গাড়ির হেডলাইড বন্ধ করার পর যায়গাটা পুরো পিচ ব্ল্যাক হয়ে গিয়েছে। তাই টর্চটা জ্বালাতে হলো, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। যেখানে প্রতিফলিত করার মতো কিছু নেই সেখানে টর্চ জ্বেলে কি লাভ । খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলাম বিশাল শেডটার দিকে ।


হঠাৎ একটা কন্টেইনারের আড়াল থেকে কেউ একজন বললো 

  • স্যার, একটু এইদিকে আসবেন ?

আমি ভাবলাম কোন আনসার সদস্য কি আমার পিছে পিছে এখানে এসেছে? ওপাস থেকে অজ্ঞাত ব্যাক্তি বললো,

  • স্যার কি ভয় পাচ্ছেন ?

আমি- আমি শব্দের উৎসের দিকে এগুতে এগুতে প্রশ্ন করলাম, 


  • আপনার কি মনে হয়, ভয় পেলে আমি কি এখানে আসতাম ?

অজ্ঞাত ব্যাক্তি- স্যার এখন আমার এইরকম দুনিয়াবী কিছু মনে আসে যায় না। আর আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। কোন কিছু করার ক্ষমতা তো ওইদিনই আগুনের তাপে গইলা এই পানিতে মিশা গেছে।


একথা শুনতে শুনতেই আমি শব্দের উৎসে নিকট পৌছে গেলাম। একজন পুরাতন কালি-ঝুলি মাখা একটা শার্ট ও লুঙ্গি পরা লোক একটা বিস্ফোরীত প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর বসে আছে, লোক বলে ভুল করলাম, এক এখন আর লোক বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না আর কি বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় তা আমার জানা নেই। তবে এখন লোক বলেই সম্বোধন করি। আর ওই অস্বস্তিকর অনুভুতিটা অনেকটা কমে এসেছে। তবে আছে। 


এধরনের স্থানের ভিকটিমরা সবাইকে সব সময় অ্যাকসেপ্ট করেনা। না করারও যথেষ্ট কারন আছে। ২৫/৫০ হাজার টাকা নাম মাত্র অনুদানে যাদের জীবনের মুল্য নির্ধারন হয়ে যায় আর কারো কারো তো দেহাবশেষও ঠিকমতো পাওয়া যায় না, নিখোঁজের তালিকায় নাম থাকতে থাকতে এক সময় মুদ্রিত কালিও ধুসর হয়ে পড়া বা চেনার অযোগ্য হয়ে যায় তাদের এই আক্রোশ স্বাভাবিক !


আমি বললাম- আমাকে এখানে ডাকার কারন ?


  • কিছু কথা ছিলো স্যার, যদি আপনার সময় থাকে তাহলে বলতাম। আমার তো এখন সময় আমার সময় আর সময়। কয়দিন পর আবার ডিপো হয়তো চালু হইয়া যাইবো, নতুন শ্রমিক আইবো আর আমি বইসা বইসা অগো কাম করা দেখুম!


আমি- বলেন, আমার সময় আছে। তবে আমাকে স্যার বলার দরকার নাই, ব্যাপারটাতে আমার অস্বস্তি লাগছে।

  • তয় কি কমু ?

আমি- ভাই বলেন ।

  • আইচ্ছা ভাই শুনেন, বেশি কথা না আপনার কাছে একটা অনুরোধ করবো যদি রাখতেন !

আমি- কি অনুরোধ ?

  • আমার বৌ, ছেলে, মা, আর ছোট ভাইে এখনো হাসপতালে গোরস্থানে আমারে বা আমার লাশটার খোজ করতাছে। ওদের যদি বলতেন যে আমি ওইসব জায়গায় নাই, আমিতো পুইড়া ছাই হইয়া এইখানেই মিশা আছি তাইলে হয়তো ওরা খোজ বন্ধ করতো। আর আরেকটা কথা ভাই, বৌডার লগে কখনো ভালো কইরা কথা কইনাই। মাইনষে কইতো, মাইয়া মাইনষেরে লাই দিতে নাই। এহন হিসাবটা মিলতাছে একভাবে, বাইরের মাইনষের কথায় পুরুষ হইতে গিয়া স্বামী হইতে পারিনাই। তয় অরে ভালোবাসতাম খুব কিন্তু কখনো বুঝতে দেই নাই। আমার এই কথাডা যদি অর কাছে পৌছাই দিতেন…


আমি- এখন আফসোস করে লাভ নেই। আর আপনার এই বার্তাটাও আমি আপনার স্ত্রীর নিকট পৌছে দিবো না। তবে তাদের আপনাকে খোজার ব্যাপারটাতে আমি তাদের সাহায্য করবো, তবে সেটা আমার মতো করে করবো। এর বেশি আমি কিছুই করতে পারবো না।

  • আমার শেষ কথাটাও আমার বৌ এর কাছে কেন পৌছায় দিতে পারবেন না?


আমি- সহ্য করতে পারবেনা ।


কথাটা বলেই তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ওই ভাঙা শেডের দিকে হাটা দিলাম। তার এখন অসীম সময় আমার সময় সীমিত। এই সময়ের মারপ্যাচে এরকম অনেক বার্তালাপই অসমাপ্ত থেকে যায়।


আমি এখানে একটা কাজে এসেছি, আগের অনুভুতি-১ নামের লেখাটাতে আপনাদের বলেই ছিলাম যে এখন কেবল শীতল শুভ্র অনুভুতিটারই খোজ করবো। তাহলে আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে আমি আবার কেন এইরকম একটা ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যাওয়া স্থানে আসলাম ?


কারণ আছে, খুব শক্তিশালী কারণ,


একটা ফোন কল। এই দূর্ঘটনা যেদিন যখন ঘটে তখন আমার কাছে একটা ফোন কল এসেছিলো। ফোনটা এসেছিলো এই ডিপোর আই.টি ডিপার্টমেন্টে মাসখানেক আগে জয়েন করা একজন কর্মকর্তার । বয়স আমার মতোই হবে বা দুই এক বছরের ছোট হবে হয়তো। রিফাত নাম ছেলেটার । সেদিনকার ফোন কলে কি কথা হয়েছিলো তা তুলে ধরছি ।


[ আপনারা হয়তো ভাবছেনে যে আমার স্ত্রী রাইসাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা আমি এখন এসব কি, মানে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করছি। হুম, আপনার মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। তবে এর উত্তর হচ্ছে এই ব্যাপারটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। ওপরে একটা অংশে একটা কথা বলেছিলাম সেটা অবার মনে করিয়ে দিলেই বুঝতে পারবেন ও উত্তরও পেযে  যাবেন “এসব নিয়ে নাড়াচাড়া না করাটাই ভালো, কারণ কখন, কিভাবে ও কোন জিনিস থেকে যে কোন ছায়া আপনার অজান্তেই আপনার সাথে লেগে যাবে তা আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না।” ]


আমি- হ্যালো, কে বলছিলেন প্লিজ ? ( ওদিকে মানুষের চিৎকার, ঘন ঘন বিশ্ফোরনের শব্দ যেন একটা যুদ্ধাবস্থা। আমি একবার চেক করলাম ফোনটা বাংলাদেশ থেকেই এসেছে)

রিফাত- এনাম সাহেব বলছিলেন ?

আমি- জ্বী। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা!

রিফাত- ভাই আমার হাতে সময় নাই, আপনি হয়তো নিউজ দেখছেন না। যাই হোক আপনার সাথে দেখা করে সামনাসামনি কথা বলার অনেক ইচ্ছা ছিলো কিন্তু সেটা স্বাবাভাবিক ভাবে আর সম্ভব না, কিন্ত সম্ভব। নিউজ দেখলে ঠিকানাটা পেয়ে যাবেন। বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। আপনার সাথে এটাই আমার শেষ ফোন ক…(একটা তীব্র বিস্ফোরোনের শব্দের সাথে ফোনটা কেটে গেলো)

না দ্বীতিয়বার ওই নম্বরে আর ট্রাই করিনি। কারণ ফোনে লাইনে থাকা অবস্থাতেই নিউজ রিপোর্টে চট্টগ্রামের ওই কন্টেইনার ডিপোর অগ্নি দুর্ঘটনার খবর আমি পেয়ে গিয়েছি। ওই নম্বরে ট্রাই করার আর কোন মানে হয়না !


তার দুই তিন ঘন্টা পরেই সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওই ডিপোর উদ্দেশ্যে ।

ঘটনাস্থলে পৌছাতে পৌছাতে সবশেষ…


আমি শেডের ভিতরে ঢোকার আগে কনস্ট্রাকশন হেলমেট, মনে ওই কনস্ট্রাকশ সাইটে ইঞ্জিনিয়াররা পরে ওই জিনিস মাথায় দিলাম আর সার্ভাইবাল টর্চটা নিয়ে আসলাম গাড়ি থেকে। গতবারের পোড়া ফ্যাক্টরির ১৫-২০ ফিট পতনের বিষয়টা মাথায় ছিলো এইবার। সেডের ভিতরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। বাইরে একটা প্রচন্ড বজ্রপাত হলো, বৃষ্টি হবে মনে হয়। কিছুটা ভেতরে যেতেই একটা রুমে আলো জ্বলতে দেখলাম, ক্ষীন সাদা আলো। তাতে অন্ধকার পুরোপুরি দূর হচ্ছেনা। কিছুটা কাছে পৌছাতেই একটা অক্ষত রুম দেখতে পেলাম। তবে আমি ভালো করেই জানি এই রুম অক্ষত নাই এখানে কোন আলোও নাই। এটা যেভাবে বুঝতে পারলাম তাহলো আমার টর্চের আলোতে আমার ছায়া পড়লেও ওই আলোতে আমার ছায়া পড়ছেনা। আর হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বিস্ফোরনের শক ওয়েভে যেখানে তিন কিলোমিটার দুরের ঘরবাড়ির কাঁচের জানালা ভেঙে চুরমার হয়েগিয়েছে সেখানে বিস্ফোরনের কেন্দ্রস্থলে কাঁচ দিয়ে পার্টিশন করা একটা কক্ষের অক্ষত থাকা সম্ভব না ! এগুলো কেবল আমাকে দেখানো হচ্ছে। পূর্বে বিভিন্ন অনুভুতি আমি অনুভব করতে পারলেও এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই আলাদা।


রুমটাতে প্রবেশ করতেই একটা আমার বয়সী ছেলে হাসি মুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন,

  • আপানার সময়জ্ঞানের প্রসংসা করতে হয় এনাম সাহেব।

আমি মৃদু হেসে বললাম, অতো ফর্মাল হতে হবেনা শরিফ ভাই। আমাকে এনাম ভাই বলে সম্বোধন করলেই আমি সাচ্ছন্দবোধ করবো। তা মৃত্যুর ঠিক আগে অতি মুল্যবান শেষ কলটা আমাকে করার কি কারণ জানতে পারি?


রিফাত - অবশ্যই। যার জন্য আপনাকে এতোটা হয়রানি করলাম সেটাই আপনাকে জানাবোনা তা কি করে হয়। আমি মুলত আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে আরো কিছুটা সমৃদ্ধ করার জন্যই ফোনটা করেছিলাম, আশা করি বিরক্ত হননি।


আমি - আপনার কি মনে হয় বিরক্ত হলে এর রাতে আপনার ভাবীকে এক প্রকার না জানিয়েই ২৬৭ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পুলিশি ঝামেলার কথা উপেক্ষা করে এই পর্যন্ত আসতাম ?

রিফাত - হুম, সেটাও ঠিক। তাহলে কারণটা বলি, আপনি এতোদিন কেবল দূর্ঘটনা ঘটার পরে সেখানে গিয়ে সেখান থেকে অনুভুতি রুপে আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে যুক্ত করেছেন কিন্তু কখনো দূর্ঘটনার ভিতর থেকে ঘটনা ঘটতে দেখেছেন?


আমি - সেটাই যদি হতো তাহলে সেই অভিজ্ঞতা বর্ননা করার জন্য আমি কি আর থাকতাম?

রিফাত- এক্সাক্টলি, আজকে আপনাকে সেটাই দেখাবো। শীতল শুভ্র অনুভুতি অনুভব করেছেন, অস্বস্তিকর উত্তপ্ত অনুভুতি অনুভব করেছেন আবার নিরব নিস্তব্ধ অনুভুতিও অনুভব করেছেন কিন্ত তাপহীন আগুন দেখেছেন কখনো ?


আমি - আপনি যখন আমাকে কল করেছিলেন তখন আপনার নামটা এবং অপনার পেশার বিবরণ একটা কলার আডেন্টিফিকেশন অ্যাপ থেকে জেনেছি, কিন্তু আপনি আমাকে ঠিক কিভাবে চিনেন বলেনতো আর আমার সম্পর্কে এতোটা জানেন কিভাবে ?


রিফাত - চলুন আজ তাপহীন আগুন, সরাসরি মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

আমি - ভোর হতেতো আর বেশি সময় বাকি নেই, ওদিকে মেইনগেটে পুলিশ চলে আসবে ।

রিফাত - আপনি হয়তো আমার কেবিনে আসার পর আর ঘড়ি দেখেননি, একবার দেখবেন কি ?


আমি প্রথমে আমার হাত গড়িটা দেখলাম, তার পর মোবাইল এবং সর্বশেষ আমার ওয়াকিটকি যেটা স্যাটেলাইট ফোন হিসেবেও কাজ করে, সব কয়টা ডিভাইসই রাত তিনটা বেজে ৯ মিনিটে আটকে গিয়েছে আর ওয়াকিটকিটা সম্পূর্ণ সাইলেন্ট। মানে কোন রেডিও সিগন্যালই এখানে প্রবেশ করছেনা! তবে আমি ব্যাপারটাতে অবাক হইনি, এই ধরনের জায়গায় এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এখানে টাইম ও স্পেসের ম্যানুপুলেটেড হওয়াটা অস্বাভাবিক না। এখানে আমি যা দেখছি বা যা দেখানো হচ্ছে তার কোনটাই বাস্তব নয় আবার ভ্রমও না। এটা একটা আলাদা ডাইমেনসন।


আমি কেবিন রিফাত সাহেবের কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম আগুনের তাপে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়া শেডটা আমি আসার সময় যেমন দেখে ছিলাম তেমনটা নেই। এখন আর টর্চের আলো লাগছেনা। শেডের বাইরে থেকে একটা হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছে আর শেডের কয়েকটা ভেন্ট দিয়ে ধোঁয়া আসছে। আমি আরো একবার ঘড়িটা দেখলাম, সময় ও তারিখ হবহু দূর্ঘটনা ঘঠা শুরু হওয়ার মুহুর্তের।

এবার আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে রিফাত সাহেব একটু হাসলেন। আমি তাকে আগের প্রশ্নটাই আবার করলাম যে আপনি আমাকে চিনলেই কিভাবে আর আমার সম্পর্কে এতো ডিটেইল জানলেন কিভাবে ?

রিফাত - আপনার মনে না থাকারই কথা, ৮-৯ বছর আগের ঘটনা তো ! আপনার মনে আছে যে আপনি প্রায়ই আপনার এন্ড্রয়েড মেবাইল ফোনে ইন্সটল করা অ্যাপ গুলো আপডেট করতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে আসতেন? ওই রেল স্টেশনে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো আপনার, কোন এক শুক্রবারে বি.এম. এ ক্যান্টনমেন্টের সামনের রেল লাইনে এক নির্মান শ্রমিকের মৃত্যুর পর সেখানে গিয়ে আপনার অদ্ভুত অনুভুতির কথা শেয়ার করেছিলেন তার সাথে ?


হ্যা, আমার স্পস্ট মনে পড়েছে। ২০১৪/১৫ সালের কথা। সে সময় ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশীই ছিলো, আর চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ছিলো ফ্রি ওয়াইফাই। আমার বাবার পোস্টিং তখন ছিলো বি.এম.এ (বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী) ক্যান্টনমেন্টে। প্রায়ই মোবেইলের অ্যাপগুলো আপডেট দিতে যেতাম স্টেশনে, তখনকার কোন এক দিনেই এই ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ফোন নম্বর ও ফেইসবুক আই.ডি বিনিময়ও হয়েছিলো। মানে এই ৮-৯ বছর যাবৎ এই ছেলে আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেই ছিলো! দেখুন না, মানুষ কতটা দুরে থেকেও কত কাছে থাকতে পারে !


আমি তাকে বললাম, থাক আর বলতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি। 


ইতমধ্যেই এখানে তান্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার চারপাশে তীব্র আগুন, কিন্তু কোন তাপ নেই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে করতেই ঘটে গেল একটা তীব্র বিস্ফোরণ কেপে উঠলো মাটি। ১০-১৫ ফুট দূরে ফেইসবুক লাইভ করতে থাকা ছেলেটা ছিটকে পড়লো অনেক দূরে, আমি জানি ও আর বেঁচে নেই। এই ঘটনা আমি টিভিতে দেখছি ঘটনার দিনই। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম এখানে আমি যাদেরকে দেখছি তাঁরা কেউই আর বেঁচে ফিরেনি, তাদের অধিকাংশই আছে নিখোাঁজের তালিকায়। কিভাবে খেয়াল করলাম সেটা হলো, সেদিন অনেক ট্রাক ড্রাইভারকেই পেছনে জ্বলন্ত ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি কিন্তু আজ তাদের কাউকে দেখিনি। এখানে কেবল পুনরাবৃতি হচ্ছে যাদের ভাগ্যে জুটেছে করুন পরিনতি তাদের জীবনের শেষ অংকটা।


বিস্ফোরনে অচেতন দেহ গুলোকে খুব দ্রুত গ্রাস করছে। তীব্রতাপে মানুষের দেহ থেকে মাংস খুলেপড়তে দেখেছেন কখনো ? আমি দেখেছি, খুব বিভৎস দৃশ্য সেটা !



ধীরে ধীরে আগুনের উজ্জ্বলতা কমে আসলো, এক সময় একেবারে অন্ধকারই হয়ে গেল। তারপর আবার চোখে অনন্ধকারটা সয়ে আসলো। রিফাতের ডাক শুণে পেছনে ঘুরে দেখতে গিয়ে মানুষের অস্থি-মজ্জা ও কেমিকেল মিশে জায়গাটা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় বেশ ভালো মতো একটা আছাড় খেলাম ওই পিচ্ছিল পানিতে জামাকাপড় ভিজে একটা বিতিকিচ্ছর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো ! তাই দেখে রিফাত ভাই বললেন “ভাই পারলে এই জামা কাপড় গুলো পুড়িয়ে ফেলবেন, এগুলো আর ব্যাবহার না করাই ভালো“ আমি শুধু বললাম হুমম,


কারন কি কারণে উনি এটা বলেছেন সেটা আমি ভালো করেই জানি। তবে এতখন যে রিফাত সাহেব আমার সাথে ছিলেন না তা আমি একেবারেই খেয়াল করিনি।


সব আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে, রিফাত ভাই বললেন-

কিভাই লিখবেন তো, আজকের তাপহীন আগুনের কথা।

আমি বলেছিলাম লিখবো ভাই, লিখবো! 


তবে ঘটনাটা যে এভাবে লিখতে হবে তা তখন বুঝতে পারিনি।


তবে আজ যাই রিফাত সাহেব কে এই কথা বলে সোজা হাটা দিলাম আমার গাড়ির দিকে, একবারও পিছন ফিরে তাকাইনি। যেখানে দেখার জন্য কিছু নেই সেখানে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে কি লাভ ! গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে মনে মনেই ঠিক করলাম চট্টগ্রামে আজ আর থাকবোনা, এখনই ঢাকায় ফিরবো। ঘড়ির দিকে খেয়াল করলাম টিক যে সময় আমি এসেছিলাম তখন থেকে মিনিট দশেক এগিয়েছে এই রাত তিনটার কাছাকাছি বাজছে মানে এই দীর্ঘ এক দেড় ঘন্টা সময় আমি আমার মতে আলাদা একটা ডাইমেনসনে ছিলাম, আপনারা বিষয়টাকে হ্যালুসিনেসন বলতে পারেন কিন্ত আমি বলবো এটা হ্যালুসিনেসন না। হ্যালুসিনেসনের ডেফিনেশন আমার জানা আছে।


আমি সিগারেট ছাড়াদুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কন্টেইনার, বিশাল বড়ো সেডের ধ্বংসাবশেষ আর কেমিকেল মিশ্রিত পানি ছাড়া কিছুই নাই। না, সেটা বললে ভুল হবে আমি যে জায়গাটাতে এসে গাড়ি দাড় করিয়েছি এখানেই সার্বধিক মানুষের উপস্থিতি ও হতাহত হওয়ার কথা যা সরকারি হিসেবের চেয়ে অনেক বেশিই হবে। সুতরাং এখানকার পনির সাথে মিশ্রিত আছে প্রচন্ড উত্তাপে গলে যাওয়া মানুষের অস্থি-মজ্জাও। যা আমার চামড়ার স্যানডেলের ভেতর প্রবেশ করে তা পিচ্ছিল করে দিচ্ছে। যে যাই বলেন, ব্যাপারটা কিন্তু অস্বস্তি কর।


গাড়ির হেডলাইড বন্ধ করার পর যায়গাটা পুরো পিচ ব্ল্যাক হয়ে গিয়েছে। তাই টর্চটা জ্বালাতে হলো, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। যেখানে প্রতিফলিত করার মতো কিছু নেই সেখানে টর্চ জ্বেলে কি লাভ । খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলাম বিশাল শেডটার দিকে ।


হঠাৎ একটা কন্টেইনারের আড়াল থেকে কেউ একজন বললো 

  • স্যার, একটু এইদিকে আসবেন ?

আমি ভাবলাম কোন আনসার সদস্য কি আমার পিছে পিছে এখানে এসেছে? ওপাস থেকে অজ্ঞাত ব্যাক্তি বললো,

  • স্যার কি ভয় পাচ্ছেন ?

আমি- আমি শব্দের উৎসের দিকে এগুতে এগুতে প্রশ্ন করলাম, 


  • আপনার কি মনে হয়, ভয় পেলে আমি কি এখানে আসতাম ?

অজ্ঞাত ব্যাক্তি- স্যার এখন আমার এইরকম দুনিয়াবী কিছু মনে আসে যায় না। আর আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। কোন কিছু করার ক্ষমতা তো ওইদিনই আগুনের তাপে গইলা এই পানিতে মিশা গেছে।


একথা শুনতে শুনতেই আমি শব্দের উৎসে নিকট পৌছে গেলাম। একজন পুরাতন কালি-ঝুলি মাখা একটা শার্ট ও লুঙ্গি পরা লোক একটা বিস্ফোরীত প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর বসে আছে, লোক বলে ভুল করলাম, এক এখন আর লোক বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না আর কি বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় তা আমার জানা নেই। তবে এখন লোক বলেই সম্বোধন করি। আর ওই অস্বস্তিকর অনুভুতিটা অনেকটা কমে এসেছে। তবে আছে। 


এধরনের স্থানের ভিকটিমরা সবাইকে সব সময় অ্যাকসেপ্ট করেনা। না করারও যথেষ্ট কারন আছে। ২৫/৫০ হাজার টাকা নাম মাত্র অনুদানে যাদের জীবনের মুল্য নির্ধারন হয়ে যায় আর কারো কারো তো দেহাবশেষও ঠিকমতো পাওয়া যায় না, নিখোঁজের তালিকায় নাম থাকতে থাকতে এক সময় মুদ্রিত কালিও ধুসর হয়ে পড়া বা চেনার অযোগ্য হয়ে যায় তাদের এই আক্রোশ স্বাভাবিক !


আমি বললাম- আমাকে এখানে ডাকার কারন ?


  • কিছু কথা ছিলো স্যার, যদি আপনার সময় থাকে তাহলে বলতাম। আমার তো এখন সময় আমার সময় আর সময়। কয়দিন পর আবার ডিপো হয়তো চালু হইয়া যাইবো, নতুন শ্রমিক আইবো আর আমি বইসা বইসা অগো কাম করা দেখুম!


আমি- বলেন, আমার সময় আছে। তবে আমাকে স্যার বলার দরকার নাই, ব্যাপারটাতে আমার অস্বস্তি লাগছে।

  • তয় কি কমু ?

আমি- ভাই বলেন ।

  • আইচ্ছা ভাই শুনেন, বেশি কথা না আপনার কাছে একটা অনুরোধ করবো যদি রাখতেন !

আমি- কি অনুরোধ ?

  • আমার বৌ, ছেলে, মা, আর ছোট ভাইে এখনো হাসপতালে গোরস্থানে আমারে বা আমার লাশটার খোজ করতাছে। ওদের যদি বলতেন যে আমি ওইসব জায়গায় নাই, আমিতো পুইড়া ছাই হইয়া এইখানেই মিশা আছি তাইলে হয়তো ওরা খোজ বন্ধ করতো। আর আরেকটা কথা ভাই, বৌডার লগে কখনো ভালো কইরা কথা কইনাই। মাইনষে কইতো, মাইয়া মাইনষেরে লাই দিতে নাই। এহন হিসাবটা মিলতাছে একভাবে, বাইরের মাইনষের কথায় পুরুষ হইতে গিয়া স্বামী হইতে পারিনাই। তয় অরে ভালোবাসতাম খুব কিন্তু কখনো বুঝতে দেই নাই। আমার এই কথাডা যদি অর কাছে পৌছাই দিতেন…


আমি- এখন আফসোস করে লাভ নেই। আর আপনার এই বার্তাটাও আমি আপনার স্ত্রীর নিকট পৌছে দিবো না। তবে তাদের আপনাকে খোজার ব্যাপারটাতে আমি তাদের সাহায্য করবো, তবে সেটা আমার মতো করে করবো। এর বেশি আমি কিছুই করতে পারবো না।

  • আমার শেষ কথাটাও আমার বৌ এর কাছে কেন পৌছায় দিতে পারবেন না?


আমি- সহ্য করতে পারবেনা ।


কথাটা বলেই তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ওই ভাঙা শেডের দিকে হাটা দিলাম। তার এখন অসীম সময় আমার সময় সীমিত। এই সময়ের মারপ্যাচে এরকম অনেক বার্তালাপই অসমাপ্ত থেকে যায়।


আমি এখানে একটা কাজে এসেছি, আগের অনুভুতি-১ নামের লেখাটাতে আপনাদের বলেই ছিলাম যে এখন কেবল শীতল শুভ্র অনুভুতিটারই খোজ করবো। তাহলে আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে আমি আবার কেন এইরকম একটা ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যাওয়া স্থানে আসলাম ?


কারণ আছে, খুব শক্তিশালী কারণ,


একটা ফোন কল। এই দূর্ঘটনা যেদিন যখন ঘটে তখন আমার কাছে একটা ফোন কল এসেছিলো। ফোনটা এসেছিলো এই ডিপোর আই.টি ডিপার্টমেন্টে মাসখানেক আগে জয়েন করা একজন কর্মকর্তার । বয়স আমার মতোই হবে বা দুই এক বছরের ছোট হবে হয়তো। রিফাত নাম ছেলেটার । সেদিনকার ফোন কলে কি কথা হয়েছিলো তা তুলে ধরছি ।


[ আপনারা হয়তো ভাবছেনে যে আমার স্ত্রী রাইসাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা আমি এখন এসব কি, মানে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করছি। হুম, আপনার মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। তবে এর উত্তর হচ্ছে এই ব্যাপারটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। ওপরে একটা অংশে একটা কথা বলেছিলাম সেটা অবার মনে করিয়ে দিলেই বুঝতে পারবেন ও উত্তরও পেযে  যাবেন “এসব নিয়ে নাড়াচাড়া না করাটাই ভালো, কারণ কখন, কিভাবে ও কোন জিনিস থেকে যে কোন ছায়া আপনার অজান্তেই আপনার সাথে লেগে যাবে তা আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না।” ]


আমি- হ্যালো, কে বলছিলেন প্লিজ ? ( ওদিকে মানুষের চিৎকার, ঘন ঘন বিশ্ফোরনের শব্দ যেন একটা যুদ্ধাবস্থা। আমি একবার চেক করলাম ফোনটা বাংলাদেশ থেকেই এসেছে)

রিফাত- এনাম সাহেব বলছিলেন ?

আমি- জ্বী। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা!

রিফাত- ভাই আমার হাতে সময় নাই, আপনি হয়তো নিউজ দেখছেন না। যাই হোক আপনার সাথে দেখা করে সামনাসামনি কথা বলার অনেক ইচ্ছা ছিলো কিন্তু সেটা স্বাবাভাবিক ভাবে আর সম্ভব না, কিন্ত সম্ভব। নিউজ দেখলে ঠিকানাটা পেয়ে যাবেন। বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। আপনার সাথে এটাই আমার শেষ ফোন ক…(একটা তীব্র বিস্ফোরোনের শব্দের সাথে ফোনটা কেটে গেলো)

না দ্বীতিয়বার ওই নম্বরে আর ট্রাই করিনি। কারণ ফোনে লাইনে থাকা অবস্থাতেই নিউজ রিপোর্টে চট্টগ্রামের ওই কন্টেইনার ডিপোর অগ্নি দুর্ঘটনার খবর আমি পেয়ে গিয়েছি। ওই নম্বরে ট্রাই করার আর কোন মানে হয়না !


তার দুই তিন ঘন্টা পরেই সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওই ডিপোর উদ্দেশ্যে ।

ঘটনাস্থলে পৌছাতে পৌছাতে সবশেষ…


আমি শেডের ভিতরে ঢোকার আগে কনস্ট্রাকশন হেলমেট, মনে ওই কনস্ট্রাকশ সাইটে ইঞ্জিনিয়াররা পরে ওই জিনিস মাথায় দিলাম আর সার্ভাইবাল টর্চটা নিয়ে আসলাম গাড়ি থেকে। গতবারের পোড়া ফ্যাক্টরির ১৫-২০ ফিট পতনের বিষয়টা মাথায় ছিলো এইবার। সেডের ভিতরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। বাইরে একটা প্রচন্ড বজ্রপাত হলো, বৃষ্টি হবে মনে হয়। কিছুটা ভেতরে যেতেই একটা রুমে আলো জ্বলতে দেখলাম, ক্ষীন সাদা আলো। তাতে অন্ধকার পুরোপুরি দূর হচ্ছেনা। কিছুটা কাছে পৌছাতেই একটা অক্ষত রুম দেখতে পেলাম। তবে আমি ভালো করেই জানি এই রুম অক্ষত নাই এখানে কোন আলোও নাই। এটা যেভাবে বুঝতে পারলাম তাহলো আমার টর্চের আলোতে আমার ছায়া পড়লেও ওই আলোতে আমার ছায়া পড়ছেনা। আর হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বিস্ফোরনের শক ওয়েভে যেখানে তিন কিলোমিটার দুরের ঘরবাড়ির কাঁচের জানালা ভেঙে চুরমার হয়েগিয়েছে সেখানে বিস্ফোরনের কেন্দ্রস্থলে কাঁচ দিয়ে পার্টিশন করা একটা কক্ষের অক্ষত থাকা সম্ভব না ! এগুলো কেবল আমাকে দেখানো হচ্ছে। পূর্বে বিভিন্ন অনুভুতি আমি অনুভব করতে পারলেও এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই আলাদা।


রুমটাতে প্রবেশ করতেই একটা আমার বয়সী ছেলে হাসি মুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন,

  • আপানার সময়জ্ঞানের প্রসংসা করতে হয় এনাম সাহেব।

আমি মৃদু হেসে বললাম, অতো ফর্মাল হতে হবেনা শরিফ ভাই। আমাকে এনাম ভাই বলে সম্বোধন করলেই আমি সাচ্ছন্দবোধ করবো। তা মৃত্যুর ঠিক আগে অতি মুল্যবান শেষ কলটা আমাকে করার কি কারণ জানতে পারি?


রিফাত - অবশ্যই। যার জন্য আপনাকে এতোটা হয়রানি করলাম সেটাই আপনাকে জানাবোনা তা কি করে হয়। আমি মুলত আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে আরো কিছুটা সমৃদ্ধ করার জন্যই ফোনটা করেছিলাম, আশা করি বিরক্ত হননি।


আমি - আপনার কি মনে হয় বিরক্ত হলে এর রাতে আপনার ভাবীকে এক প্রকার না জানিয়েই ২৬৭ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পুলিশি ঝামেলার কথা উপেক্ষা করে এই পর্যন্ত আসতাম ?

রিফাত - হুম, সেটাও ঠিক। তাহলে কারণটা বলি, আপনি এতোদিন কেবল দূর্ঘটনা ঘটার পরে সেখানে গিয়ে সেখান থেকে অনুভুতি রুপে আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে যুক্ত করেছেন কিন্তু কখনো দূর্ঘটনার ভিতর থেকে ঘটনা ঘটতে দেখেছেন?


আমি - সেটাই যদি হতো তাহলে সেই অভিজ্ঞতা বর্ননা করার জন্য আমি কি আর থাকতাম?

রিফাত- এক্সাক্টলি, আজকে আপনাকে সেটাই দেখাবো। শীতল শুভ্র অনুভুতি অনুভব করেছেন, অস্বস্তিকর উত্তপ্ত অনুভুতি অনুভব করেছেন আবার নিরব নিস্তব্ধ অনুভুতিও অনুভব করেছেন কিন্ত তাপহীন আগুন দেখেছেন কখনো ?


আমি - আপনি যখন আমাকে কল করেছিলেন তখন আপনার নামটা এবং অপনার পেশার বিবরণ একটা কলার আডেন্টিফিকেশন অ্যাপ থেকে জেনেছি, কিন্তু আপনি আমাকে ঠিক কিভাবে চিনেন বলেনতো আর আমার সম্পর্কে এতোটা জানেন কিভাবে ?


রিফাত - চলুন আজ তাপহীন আগুন, সরাসরি মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

আমি - ভোর হতেতো আর বেশি সময় বাকি নেই, ওদিকে মেইনগেটে পুলিশ চলে আসবে ।

রিফাত - আপনি হয়তো আমার কেবিনে আসার পর আর ঘড়ি দেখেননি, একবার দেখবেন কি ?


আমি প্রথমে আমার হাত গড়িটা দেখলাম, তার পর মোবাইল এবং সর্বশেষ আমার ওয়াকিটকি যেটা স্যাটেলাইট ফোন হিসেবেও কাজ করে, সব কয়টা ডিভাইসই রাত তিনটা বেজে ৯ মিনিটে আটকে গিয়েছে আর ওয়াকিটকিটা সম্পূর্ণ সাইলেন্ট। মানে কোন রেডিও সিগন্যালই এখানে প্রবেশ করছেনা! তবে আমি ব্যাপারটাতে অবাক হইনি, এই ধরনের জায়গায় এমন অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এখানে টাইম ও স্পেসের ম্যানুপুলেটেড হওয়াটা অস্বাভাবিক না। এখানে আমি যা দেখছি বা যা দেখানো হচ্ছে তার কোনটাই বাস্তব নয় আবার ভ্রমও না। এটা একটা আলাদা ডাইমেনসন।


আমি কেবিন রিফাত সাহেবের কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম আগুনের তাপে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়া শেডটা আমি আসার সময় যেমন দেখে ছিলাম তেমনটা নেই। এখন আর টর্চের আলো লাগছেনা। শেডের বাইরে থেকে একটা হৈ চৈ এর আওয়াজ আসছে আর শেডের কয়েকটা ভেন্ট দিয়ে ধোঁয়া আসছে। আমি আরো একবার ঘড়িটা দেখলাম, সময় ও তারিখ হবহু দূর্ঘটনা ঘঠা শুরু হওয়ার মুহুর্তের।

এবার আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে রিফাত সাহেব একটু হাসলেন। আমি তাকে আগের প্রশ্নটাই আবার করলাম যে আপনি আমাকে চিনলেই কিভাবে আর আমার সম্পর্কে এতো ডিটেইল জানলেন কিভাবে ?

রিফাত - আপনার মনে না থাকারই কথা, ৮-৯ বছর আগের ঘটনা তো ! আপনার মনে আছে যে আপনি প্রায়ই আপনার এন্ড্রয়েড মেবাইল ফোনে ইন্সটল করা অ্যাপ গুলো আপডেট করতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে আসতেন? ওই রেল স্টেশনে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো আপনার, কোন এক শুক্রবারে বি.এম. এ ক্যান্টনমেন্টের সামনের রেল লাইনে এক নির্মান শ্রমিকের মৃত্যুর পর সেখানে গিয়ে আপনার অদ্ভুত অনুভুতির কথা শেয়ার করেছিলেন তার সাথে ?


হ্যা, আমার স্পস্ট মনে পড়েছে। ২০১৪/১৫ সালের কথা। সে সময় ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশীই ছিলো, আর চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ছিলো ফ্রি ওয়াইফাই। আমার বাবার পোস্টিং তখন ছিলো বি.এম.এ (বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী) ক্যান্টনমেন্টে। প্রায়ই মোবেইলের অ্যাপগুলো আপডেট দিতে যেতাম স্টেশনে, তখনকার কোন এক দিনেই এই ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ফোন নম্বর ও ফেইসবুক আই.ডি বিনিময়ও হয়েছিলো। মানে এই ৮-৯ বছর যাবৎ এই ছেলে আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেই ছিলো! দেখুন না, মানুষ কতটা দুরে থেকেও কত কাছে থাকতে পারে !


আমি তাকে বললাম, থাক আর বলতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি। 


ইতমধ্যেই এখানে তান্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার চারপাশে তীব্র আগুন, কিন্তু কোন তাপ নেই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে করতেই ঘটে গেল একটা তীব্র বিস্ফোরণ কেপে উঠলো মাটি। ১০-১৫ ফুট দূরে ফেইসবুক লাইভ করতে থাকা ছেলেটা ছিটকে পড়লো অনেক দূরে, আমি জানি ও আর বেঁচে নেই। এই ঘটনা আমি টিভিতে দেখছি ঘটনার দিনই। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম এখানে আমি যাদেরকে দেখছি তাঁরা কেউই আর বেঁচে ফিরেনি, তাদের অধিকাংশই আছে নিখোাঁজের তালিকায়। কিভাবে খেয়াল করলাম সেটা হলো, সেদিন অনেক ট্রাক ড্রাইভারকেই পেছনে জ্বলন্ত ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি কিন্তু আজ তাদের কাউকে দেখিনি। এখানে কেবল পুনরাবৃতি হচ্ছে যাদের ভাগ্যে জুটেছে করুন পরিনতি তাদের জীবনের শেষ অংকটা।


বিস্ফোরনে অচেতন দেহ গুলোকে খুব দ্রুত গ্রাস করছে। তীব্রতাপে মানুষের দেহ থেকে মাংস খুলেপড়তে দেখেছেন কখনো ? আমি দেখেছি, খুব বিভৎস দৃশ্য সেটা !



ধীরে ধীরে আগুনের উজ্জ্বলতা কমে আসলো, এক সময় একেবারে অন্ধকারই হয়ে গেল। তারপর আবার চোখে অনন্ধকারটা সয়ে আসলো। রিফাতের ডাক শুণে পেছনে ঘুরে দেখতে গিয়ে মানুষের অস্থি-মজ্জা ও কেমিকেল মিশে জায়গাটা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় বেশ ভালো মতো একটা আছাড় খেলাম ওই পিচ্ছিল পানিতে জামাকাপড় ভিজে একটা বিতিকিচ্ছর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো ! তাই দেখে রিফাত ভাই বললেন “ভাই পারলে এই জামা কাপড় গুলো পুড়িয়ে ফেলবেন, এগুলো আর ব্যাবহার না করাই ভালো“ আমি শুধু বললাম হুমম,


কারন কি কারণে উনি এটা বলেছেন সেটা আমি ভালো করেই জানি। তবে এতখন যে রিফাত সাহেব আমার সাথে ছিলেন না তা আমি একেবারেই খেয়াল করিনি।


সব আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে, রিফাত ভাই বললেন-

কিভাই লিখবেন তো, আজকের তাপহীন আগুনের কথা।

আমি বলেছিলাম লিখবো ভাই, লিখবো! 


তবে ঘটনাটা যে এভাবে লিখতে হবে তা তখন বুঝতে পারিনি।


তবে আজ যাই রিফাত সাহেব কে এই কথা বলে সোজা হাটা দিলাম আমার গাড়ির দিকে, একবারও পিছন ফিরে তাকাইনি। যেখানে দেখার জন্য কিছু নেই সেখানে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে কি লাভ ! গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে মনে মনেই ঠিক করলাম চট্টগ্রামে আজ আর থাকবোনা, এখনই ঢাকায় ফিরবো। ঘড়ির দিকে খেয়াল করলাম টিক যে সময় আমি এসেছিলাম তখন থেকে মিনিট দশেক এগিয়েছে এই রাত তিনটার কাছাকাছি বাজছে মানে এই দীর্ঘ এক দেড় ঘন্টা সময় আমি আমার মতে আলাদা একটা ডাইমেনসনে ছিলাম, আপনারা বিষয়টাকে হ্যালুসিনেসন বলতে পারেন কিন্ত আমি বলবো এটা হ্যালুসিনেসন না। হ্যালুসিনেসনের ডেফিনেশন আমার জানা আছে।


আমি সিগারেট ছাড়া...

পরবর্তী পর্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ