অনুভূতি - ২ (পর্ব-৬)




 একটু সাইডে চলে গেলাম আরেকটা সিগারেট কিনবো তাই। তো কথাটা একটু লম্বাই হয়ে গেলো, এই ১০ মিনিট মতো। 

ঘুরে এসে দেখলাম রাইসা একটা জুটির সাথে কথা বলছে। আমি ওদের চিনতে পারলামনা। আমি কাছে যেতেই রাইসা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, লোকটার নাম সাকিব। এটাই সেই লোকটা যার সাথে ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। আমি সালাম বিনিময় করে রাইসাকে বললাম চলো তাহলে যাওয়া যাক আর সিগারেটটা জ্বালালাম। 

এবার লোকটা আমার মেজাজ খারপ করে দিলো,

আসলে আমার আমার আর রাইসার পোশাকের অবস্থা বেশটাই খারপ ছিলো। লোকটা আমাকে আবার বললো এতোদিন পর হানিমুনে আসলেন বুঝি? (আসলে এইটাইপের শব্দগুলো আমার বা রাইসার কারো কাছেই কোন গুরুত্ব বহণ করেনা)


আমি বললাম- না। এমনিতেই ঘুরতে এসছি। এবারই প্রথম।

তো ডমেস্টিক অ্যানিমেলটা একটা ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে বললো,


-নন এসি বাসে এসেছেন বোধহয়। তাই দুজনকেই এমন দেখাচ্ছে। আসরে এসি কোচ গুলোর ভাড়া এতো বেশি যে সবাই অ্যাফোর্ড করতে পারেনা। আবার এসি কোচেও শান্তি নেই, প্রায়ই পুলিশ চেকিং এর নামে ডিস্টার্ব করে। তো এসেই মার্কেটে? তেমন কোন পুলিশি ঝামেলায় পড়েছিলেন নাকি?


এই কথাটা শুনে ওর নিজের স্ত্রীও বিব্রত হলেন। আর রাইসাকে দেখলাম অন্যদিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।


আমি- খালি বললাম না ভাই, তেমন কিছু না। আজ যাই, আসলে খুব ক্লান্ত। সারারাত ড্রাইভ করে এসেছিতো!

সাকিব- ভাই কি তাহলে এখন বাস ট্রান্সপোট লাইনে আছেন নাকি? মানে ট্রাক হলেতো আর আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসতে পারতেন না আর কি। আচ্ছা আপনার ফেইসবুক আই.ডিটা দিন, যোগায়োগ থাকবে আর কি।


আমি জানি একজন বাস ড্রাইভারের সাথে এই কর্পোরেট শালার যোগাযোগ রাখার কোন দরকারই নেই, ও ওর নিজের লাইফস্টাইল দেখানোর জন্য আমাকে অ্যাড করতে চাইছে। তো আমি কিছু বলার আগে রাইসাই আমার আই.ডিটা দিয়ে দিলো। ওকে দেখ বুঝুতে পারলাম খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছে!


আমি- সেরকমই মনে করেন। আমরা বরং যাই স্যার যেহেতু কয়েকদিন আছি আবার দেখা হবে ইনসাআল্লাহ্। আমাদের আবার কম দামে ভালো হোটেল খুজতে হবে। (আমার রাগ নেই বললেই চলে, বা সামান্য একটু হলেও সেটা আমি কারো সামনে প্রকাশ করিনা। কিন্তু এই লোকটা এতোটাই মাত্রা চাড়িয়ে গিয়েছে যে তার নিজের স্ত্রীও তার ওপর রেগে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।)


রাইসা আমার স্যার বলা দেখে আর হাসি আটকে রাখতে পারলোনা। ও হেসেই চলেছে, আমি থামানোর চেষ্ট করছি কিন্তু ও থামছেনা। আমি নিরুপায় হয়ে গাড়ির দিকে হাটা দিলাম আর ও ওখানে দাড়িয়ে হেসেই চলেছে, পাগলী মেয়ে একটা।


আমি প্রায়ই ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত করি, আমার গাড়িতে আর্মি আর প্যারা কমান্ডো দুটো স্টিকারই লাগানোই আছে। একজন খুব সিনিয়র অফিসার সেদিন আমাকে অবার জয়েনের অফার ও করেছেন আর বলেছেন তুমি খালি ভুড়ি কমাও আর অফারটা অ্যাকসেপ্ট করো বাকিটা আমি সামলে নিবো। 

আমার যে এখন ইচ্চা করেনা তা না, আমি বলেছিলাম স্যার ভুড়ি বিষয় না কিন্তু যে বিজনেসটা শুরু করেছি, উনি সেটারও উপায় বাতলে দিয়েছেন। আজকের ঘটনার পর আমার মনে হচ্ছে এবারই ঢাকায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করবো। 

আমাদের গাড়িটা ওখানেই দাড় করানো ছিলো। আমি যখন গিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করলাম। ওই কর্পোরেট অ্যানিমেলটার চোখ সরাসরি আমার উইন্ডসিল্ডে লাগানো স্টিকার আর গাড়ির লোগোর ওপর পড়লো। রাইসা হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে বসে আবারো হাসতে লাগলো। সাকিবদের পিছনে ফেলে সামান্য সামনে আগাতেই, রাইসা বললো গাড়ি পিছনে নিয়ে ছাগলটার সামনে দাড় করাও। 

আমি তাই করলাম, রাইসা গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললো পুলিশ/বি.জি.বি কেউ সমস্যা করলে ওকে ফোন কোর। ড্রাইভার তো, তাই ওদের সাথে ওর সম্পর্ক ভালো। সমস্যা হলে সমাধান করে দিবে। আর ওর ফেইসবুক প্রোফাইলটা চেক করলে ওর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটা ধারনা পাবেন। দেখা হবে। 


রাইসার কথা শেষ হতেই আমি একটা ছোট্ট Wheel burnout (যেটুকু পাবলিক্যালি করাযায়) করে বেরিয়ে গেলাম। আর মিররে দেখলাম আমাদেরে দিকে তাকিয়ে আছে! 

রাইসা- বাসড্রাইভারের রাগ হয়েছে নাকি? বলে আবার হাসতে শুরু করলো।

এবার আমিও হেসে ফেলাম।

আমি- বাসড্রাইভারের বৌ তোমার মতো হলে বাস ড্রাইভারের আবার রাগ হয় কিভাবে!!

 

বেশ কিছুক্ষন ঘোরাঘুরির পর একটা ভালো হোটেল পাওয়া গেলো। রাইসা বাথরুমে গেল। আমি এই সুযোগেই আমি রুমের মধ্যেই কাপড় বদলে বিছানায় চিৎ হলাম। কিছুক্ষন পর রাইসা এসে বললো গোসল করবেনা?

আমি সামান্য চোখ খুলে বললাম গতকালরাত থেকে একটানা যথেষ্ট গোসল হয়েছে। এখন আমি বিছানা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা।

রাইসা- খাবার যে নিয়ে আসলে সেটা খাবে তো।

আমি- আসলে ক্লান্তিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। এক কাজ করো দুটো প্যাকেটের খাবার এক জায়গায় করো, তারপর তুমি নিজেও খাও আমাকেও খাইয়ে দাও।

রাইসা তাই করলো। খাওয়া শেষে বুঝতে পারলাম বিছানা থেকে আমাকে উঠতেই, কারন মুখতো ধুতে হবে! মুখ ধুয়ে এসে একটা ঘুম দিলাম। এবং আমি চাচ্ছিলাম যেন কোন স্বপ্ন না দেখি। আমার আসলেই এসব ব্যাপারে আর বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। ঘুম ভাঙলো রাত বারোটার দিকে, দেখলাম রাইসা সি ফেইসিং বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছে।

আমি বারান্দায় গিয়ে প্রথমে ঘরের দরজাটা আটকে দিলাম, কারণ সিগারেট ধরাবো। আর বারান্দা দিয়ে যেভাবে বাতাস আসছে তাতে সব ধোঁয়া ঘরে ঢুকবে। আমি সিগারেট পছন্দ করলেও ঘরের মধ্যে বা বদ্ধ জায়গায় সিগারেটের ধোঁয়া পছন্দ করি না। 

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে রাইসাকে বললাম কফি কোথায় পেলে?

রাইসা- তুমি খাবে?

আমি- হলে মন্দ হয়না।

ও ভেতরে গেল ইন্টারকমে কফি অর্ডার করতে। 

রাইসার ব্যাপারে একটা অদ্ধুত বিষয় হলো এই মেয়েটা আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে কখনো অভিযোগ করেনা, হোক সেটা গাড়িতে বা বারান্দায়। না তাই বলে উৎসাহ দেয় তা না, বলে এসব ছেড়ে দেওয়াই ভালো আর আমি বলি আস্তে আস্তে ছেড়ে দিবো। এই বিষয়টা এই পর্যন্তই থাকে।

রাইসা একেবারে কফি সাথে নিয়েই আসলো। আমি রাইসাকে বললাম এই হোটেল ওয়ালারা দেখছি খুব ফাস্ট।


রাইসা- হুমম সেটা বলতে পারো। আচ্ছা বাইরে যাবে?

আমি- এখন?

রাইসা- কেন কোন অসুবিধা?

আমি- না অসুবিধা হবে কেন? কিন্তু যাবো কোথায় এখানে তো তেমন কিছুই চিনি না।

রাইসা- বীচে যাই চলো।

আমি- কফি আর সিগারেট শেষ করে বললাম, চলো।


আমি সাধারণত ওয়াকিটকিটা খুব কমই হাত ছাড়া করি। ওটা সাথে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কাছাকাছি স্থান গুলোতে আলোক দূষণ একটু বেশিই আমারা একটু অন্ধকারের দিকে গেলাম। 


আমার খুব শখ ছিলো রাইসার হাত ধরে সহস্র নক্ষত্র থচিত আকাশের নিচে হাটবো, পাশে ধীরে ধীরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়বে সেখান থেকে ছড়াবে বায়োলুমিনেসেন্ট প্লাঙ্কটনের নীলাভ আলো। আচ্ছা সেই আলোতে রাইসাকে দেখতে কেমন লাগবে?

সে উত্তর জানা গেলোনা, কারণ সেটা জানতে হলে মালদ্বীপ যেতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে বায়োলুমিনেসেন্ট প্লাঙ্কটনের দেখা পাওয়া যায়না। রাইসা বললো বসতে ইচ্ছা করছে,

আমি আর রাইসা একটু সামনে গিয়ে (পানির দিকে এগিয়ে, কিন্তু পানিতে নামিনি এমনিতেই যথেষ্ট ভেজা হয়েছে) বালির ওপরই বসলাম।

ও ঠিক সেভাবেই আমার হাত জড়িয়ে কাছে ঘেষে বসলো। আকাশে অজস্র তারা, চোখে অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় সামনের সমুদ্র্রও দেখা যাচ্ছে। আজ নিজেকে আসলেই পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।

এভাবে বসে থাকতে থাকতে ফজরের আজান হয়ে গেল কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা কথাও হলোনা। 


আসলে আমরা এভাবে একজন আরেকজনে কখনো সময় দেইনি, এখন বুঝতে পারছি যে কি ভুল করেছি! এটাই ভাবছিলাম। তখন রাইসা পাশ থেকে বললো,

-চলো উঠি, ক্ষুধা লেগেছে।


আমি বললাম চলো। ঠিক মতো ঘুম না হওয়ার কারনে ওর চোখে একটা নেশা নেশা ঘোর লেগে আছে, ইচ্ছা করছে এই ঘোর লাগা চোখে হারিয়ে যাই। 

রাইসা, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চশমাটা ঠিক করতে করতে বললো সামনের দিকে তাকিয়ে হাটো, হোচট খেয়ে পড়ে যাবেতো!

আমি আবারও কিছুটা লজ্জা পেলাম আর সেটা দেখে রাইসা এবার কিছু না বললেও মুচকি হাসলো। 


আমারা সকালের নাস্তা করে, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে, একটা অপরিচিত নম্বর। আমি সাধারণত অপরিচিত নম্বর থেকে আশা ফোন রিসিভ করিনা, কিন্তু আজ কি মনে করে যেন করলাম।


ওপাশথেকে- আসসালামুআলাইকুম, আমি কি এনাম সাহেবের সাথে কথা বলছি?

আমি- ওয়ালাইকুম-আস-সালাম, জ্বী। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।


ওপাশথেকে- আমাকে আপনার চিনতে পারার কথা না। আমি, রশিদুল ইসলাম। ঢাকা থেকে বলছিলাম। সিলেট থেকে আশার পথে ট্রেনে একজন মুরুব্বী আপনার নম্বর দিয়েছিলেন। ভাই আমার মেয়েটাকে বাঁচান ভাই, আপনিই আমার শেষ ভরসা। এমন কোন জায়গা নেই যে আমি যাইনাই। আমার একটাই মেয়ে ভাই। ( কথগুলো এক নিঃস্বাসে বলে লোকটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন)

আমি উনাকে না করেই দিতাম, কিন্তু উনার কান্না শুনে আমি না করতে পারলাম না।

আমি- আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, আচ্ছা আমার নম্বরটা আপনাকে যে মুরুব্বী দিয়েছেন তার শরীর থেকে অদ্ভুত একটা আতরের সুগন্ধ আসছিলো তাইনা?


রশিদ সাহেব- জ্বী। (আমি বুঝতে পারলাম আমার ফোন নম্বরটা ওই চাচাই উনাকে দিযেছেন। আর এই মেয়েটার কথাই চাচা সেদিন রেল স্টেশনে আমাকে বলেছিলেন। তবে এটা কোন ভাবেই মনে করতে পারলামনা যে আমি উনাকে কখন আমার ফোন নম্বর দিলাম আবার হলো কখনো হয়তো দিয়েছি এখন মনে নেই) আপনি কখন আসবেন, এদিকে অবস্থা খুব খারাপ ভাই?

আমি- তো মেয়েকে এই অবস্থায় রেখে সিলেট কি করতে গিয়েছিলেন? দেখুন আমি ঢাকার বাইরে আছি, ফিরেই আপনার সাথে দেখা করবো। আপনার ঠিকানাটা দিন।


রশিদ সাহেব বললেন ওখানে এই সমস্যার সমাধানের জন্য একজনের কাছে গিয়েছিলেন, তবে যার কাছে তিনি রাজি হননি। তিনি বলেছেন এসবের পেছনে যে জিনিস আছে তাকে থামানোর ক্ষমতা এখন আর আমার নেই, ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে। এখানে আপনার মেয়ের এবং আপনার মেয়েকে যে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে উভয়েরই প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। খালি একটা পরামর্শ দিয়েছেন, আল্লাহ্ কে ডাকতে। আল্লাহ্ চাইলে পারেন না এমন কিছু নেই। 


আমি এদিকে ভাবছি একজন প্রফেশনাল মানে আমি সেভাবে মিন করতে চাইনি, যার এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে তিনিই পিছিয়ে গিয়েছেন এখানে আমি কিই বা করতে পারবো।


আমি- দেখুন রশিদ সাহেব, হায়াত-মওউত আমাদের হাতে না। আমি দেখছি কি করা যায়। আচ্ছা আমি আপনাকে ঢাকায় ফিরে ফোন করবো।


রশিদ সাহেব- আপনি বাসায় থাকলে আমাকে ফোনে পাবেন না, ওই ঘটনা শুরু হওয়র পরথেকে বাসার মধ্যে কারো ফোনেই নেটওয়ার্ক থাকে না। বাসার প্রতিটা ঘড়িই রাত ৩ বেজে ৩৬ মিনিটে আটকে গিয়েছে বহু ব্যাটারী পরিবর্তন করেও কোন লাভ হয়নি। আমি ঠিকানা দিচ্ছি আপনি বরং সরাসরি আমার বাসায় আসুন। আমি ঠিকানা আপনাকে ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।

আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোনটা রেখে দিলাম।


এবার আমি আর রাইসার কাছে কিছু লুকালাম না, সবটাই ওকে বলে দিলাম। আমি ভেবে ছিলাম রাইসা আমাকে বাধা দিবে। কিন্তু রাইসা খালি বললো, 

  • দেখ তুমি আমার একমাত্র অবলম্বন। হারিয়ে যেও না। আর মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব বিপদে আছে। চলো আজই রওনা দিবো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর একটা আবদার, আমি তোমার সাথে ওখানে যেতে চাই। নিয়ে যাবে?


এই মেয়েটা যে শত ভাগ স্বর্ণ, ওর মধ্যে বিন্দু মাত্র খাদ নেই তা বুঝতে আমার আর বাকি নেই। যদিও ইচ্ছা করছিলোনা তার পরেও বললাম, “হুমম নিয়ে যাবো”     


আমরা পরিকল্পনা করলাম আমরা রাতে রওনা দিবো। আমাদের গোছানোর মতো তেমন কিছুতো ছিলো না আমি বললাম রাইসা কফি খাবো, তুমি খাবে?

রাইসা- হুমম, অর্ডার দাও।


তো রাত ১২টার দিকে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাইসা জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আমাদের ঢাকায় পৌছাতে কত সময় লাগতে পারে, আর তুমি কি সরাসরি উনাদের বাসায় যাবে?

আমি বললাম ঢাকায় পৌছাতে পৌছাতে ৬/৭ ঘন্টা সময় লাগতে পারে আর না, পৌছেই উনার বাসায় যাবোনা। 


তো ৭ টা ৮টার দিকে ঢাকায় পৌছে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার (আসার সময় একটা হোটেল থেকে ডাল-পরোটা নিয়ে এসেছিলাম) সারাদিন ঘুমিয়েই কাটালাম।


শেষ বিকেলে ঘুম ভাঙলো। রাইসা ওর ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো, আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে বললো কফি খাবে?

আমি বললাম হুমম।

রাইসা বললো ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি কফি বানিয়ে আনছি।


আমি বাথরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। মুখে কেবল পানির প্রথম ছিটা দিয়েছি চোখ খোলার পর আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলাম আমার ঠিক পেছনেই ঘন জমাট বাধা অন্ধকার সেই অবয়বটা দাড়িয়ে আছে। আমি চমকে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি জানি আমার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই, সংযোগও নেই এর পক্ষে আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। হঠাৎ মনে পড়লো রাইসার কথা, ও গ্যাসের চুলায় কফি বানাতে গিয়েছে। আমি যদিও যানি এর সাথে ওর সমস্ত সংযোগ আমি বিচ্ছিন্ন করেছি, তার পরেও দ্বিতীয় কোন কথা চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে সরাসরি কিচেনে দৌড় দিলাম,

কিচেন পর্যন্ত যেতে হলোনা। বেডরুমের দরজা খুলতেই দেখলাম ও কফি হাতে এদিকেই আসছে। ও আমাকে এভাবে দেখে বললো মুখ মুছে আসবে না? তোয়ালে তো বাথরুমেই ছিলো। 

আমি কোন কথা না বলে ওর ওরনাটা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললাম তাহলে এটা আছে কি করতে? 


বাথরুমের ঘটনাটা আমি এড়িয়ে গেলাম। জিনিসটা এখানে কোন ক্ষতি করতে এসেছিলো না, এসেছিলো সাবধাণ করতে। কিন্তু আমি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি, এটা পয়েন্ট অফ নো রিটার্ণ।

বারান্দায় দাড়িয়ে রাইসা কফি খেতে খেতে বললো যাবেনা ওখানে?


আমি- আরেকটু পরেই যাবো। কিন্তু ভাবছি যে ওখানে গিয়ে কি পরিস্থিতিতে পড়বো আর কি করবো।

রাইসা শুধু বললো, চিন্তা কোরনা। পথই পথের সন্ধান দিবে।

ওর মুখে এই কথাটা শুনে আমি শুধু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম!


রাত ১১ টার দিকে আমি আর রাইসা বের হলাম বাসা থেকে। রশিদ সাহেবের বাসা হেমায়েতপুরের কোন একটা অঞ্চলে। রাত ১০ টার পর থেকে ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম কমতে শুরু করে তাই এই দেরী করে বের হওয়া। তার পরেও পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে বারোটা বেজে গেলো। আশেপাশের সকল বাসায় আলো থাকলেও উনাদের বাসাটা অন্ধকার। আমি বাসায় গিয়ে বেশ কয়েকবার নক করলাম কিন্তু কেউ দরজা খুললোনা।


আমি রশিদ সাহেবে কে ফোন করে বললাম যে আমি উনার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি, এবং অনেকক্ষন ধরে বেল দিচ্ছি কিন্তু আপনারা কেউ দরজা খুলছেন না কেন? উনি বললেন, আমার মেয়ে ছাড়া কেউ বাড়িতে নেই। তাছাড়া যে মুরুব্বী অমাকে আপনার ফোন নম্বর দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন আপনাকে ফোন করার পর আমরা কেউ যেন মেয়ের সাথে একই বাড়িতে বিশেষ করে রাতে না থাকি, তাই রাতে আমি আপনার ভাবীকে নিয়ে পাশেই আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি ৫ মিনিট দাড়ান আমি আসছি।


আমি উনার স্ত্রীকে আর নিকটস্থ মসজিদের ইমামকে সাথে নিয়ে আসতে বললাম, কেন বললাম জানিনা তবে মনে হলো দরকার হতে পারে। আমি বাড়িটা সম্পর্কে আপনাদের একটা ধারণা দেই, দোতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে প্রাচীর দেওয়া আর রাস্তার পাশে মেইন গেইট, গেইটের সামনেই আমাদের গাড়িটা পার্ক করেছি যদিও স্টার্ট বা হেডলাইট কোনটাই বন্ধ করিনি।

উনার আসতে দেরী হচ্ছে বলে আমি কৌতুহল বসত মেইন গেইটে হালকা ধাক্কা দিতেই বুঝতে পারলাম গেইটটা খোলা। আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম রাইসাও আমার পেছন পেছেন আসলো। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই আমার ওই অস্বস্তিকর অনুভুতিটা বেড়ে গেলো। যাই হোক, এবার আসি বাড়ির ভেতরের বর্ণনায়,

বাড়ির সামনে সামান্য খোলা জায়গা, মেইন গেইট দিয়ে সোজা একটা রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে বাড়ির দরজায়। মেইন গেইট খোলা থাকলেও বাড়ির দরজার কলাপসিবল গেইটে তালা দেওয়া। আর কলাপসিবল গেইটটা নতুন লাগানো এটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে হঠাৎ একটা ছেলে এসে বেশ অধিকারবোধ নিয়েই আমাদের জিজ্ঞাসা করলো আপনারা কারা, এখানে কি করছেন?

ছেলেটার মধ্যে অধিকারবোধ থাকলেও তা আমার কাছে ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে হলোনা আর এরই মধ্যে ওয়াকিটকিটাতে একটা অস্পষ্ট সিগণ্যালের আওয়াজ হলো এবং তাতে ছেলেটা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো আপনারাকি পুলিশের লোক। আমি এবারো কেন উত্তর দিলাম না। আমি তখন বাড়িটা পর্যবেক্ষণ ও সেটার মধ্যে সামান্যতম অসংলগ্নতা খুজতে ব্যাস্ত, ছেলেটার প্রশ্নে আমি কিছুটা বিরক্তই হচ্ছিলাম। 

আমার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ছেলেটা ফিরে যখন ফিরে যাচ্ছিল আমি তখন প্রশ্ন করলাম তুই কে? এতো রাতে এখানে কি করছিস?

এবার ছেলেটা চরম ভাবে ঘাবড়ে গিয়ে কাপা কাপা গলায় বললো না, মানে এদিক দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। খালি বাড়িতে আপনাদের ঢুকতে দেখে সন্দেহ হলো তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম আর কি। আমি এখন যাই বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। আমি ছেলেটাকে তুই করে বলেছিলাম কারণ আমার একে সন্দেহ হয়েছিলো, এখন সেটা পাকাপোক্ত হলো কারণ এই রাস্তায় এটাই শেষ বাড়ি। এরপর এখানে ফেরার মতো কোন বাড়ি নেই, এটা ডেড এন্ড।


ছেলেটা মেইন গেইট দিয়ে বের হতে যাবে ঠিক সে সময়ই রশিদ সাহেব প্রবেশ করে ওই ছেলেটাকে দেখে যারপর নাই রেগেগিয়ে ওর কলার চেপে ধরে বলরেন তুই এখানে? তোকেনা বলেছি আমার মেয়ের আশেপাশেও যেন তোকে কখনো না দেখি। এ কথা বলেই ছেলেটাকে মারতে শুরু করলেন।


আমি গিয়ে বললাম এখন ঝামেলা করার সময়না, একে ছাড়েন। আরে কলাপসিবল গেইটের তালাটা খুলেন।

উনি আমাকে দেখে কিছুটা হতাশ হলেন বলে মনে হলো, উনি আশা করেছিলন আমি দাড়ি-টুপি-জুব্বা পরা কেউ হবো। দাড়ি আমার আছে কিন্তু উনি শার্ট-প্যান্ট-ওয়াকিটকি সহ কউকে আশা করেন নি। ততক্ষনে রাইসা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।

রশিদসাহেব বললেন- আপনিই কি এনাম সাহেব?

আমি- হ্যা্।

তার পর উনি রাইসার দিকে ইশারা করে বললেন উনি কে?

আমি বললাম আমার স্ত্রী, ডা. রাইসা এনাম। তারপর বললাম, তালাটা খুলেন।


উনি তালাটা খুলে দেওয়ার পরে সবার আগে আমিই ভিতরে ঢুকলাম, আমি রশিদ সাহেবকে লাইট জ্বালাতে বললে উনি জানালেন এ বাড়ির কোন বৈদ্যুতিক বাতিই ঠিক নেই। আমি বললাম,

  • কই আমার ওয়াকিটকিতো ঠিকই কাজ করছে। আর রাইসাকে বললাম টর্চটা দিতে।

টর্চটা জ্বালানোর পর দেখাগেল ওটাও দিব্বি জ্বলছে। রশিদ সাহেবের চেহারা দেথে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে উনি ইতোমধ্যেই আমার ওপর ভরসা করতে শুরু করেছেন। তো বাড়ির দরজাটা দিয়ে প্রবেশ করার পর বাম পাশদিয়ে একটা সিড়ি দোতলায় উঠে গিয়েছে, সিড়িটার তলে একটা মটরসাইকেল আর পার্কিং টাইলস রাখা আর নিচে মেঝের বদলে মাটি। মানে এখানে কাজ চলছে।

আমি কিছুটা এগুনোর পরেই হঠাৎ ওয়াকিটকিটা সম্পূর্ণ সাইলেন্ট হয়ে গেলো। আমি সাথে সাথেই ঘড়ির দিকে তাকালাম, সেটা ৩ বেজে ৩৬ মিনিটে আটকে গিয়েছে কিন্তু এখন সর্বোচ্চ দেড়টা থেকে দুইটা বাজে। আর এই জায়গাটা থেকেই মারাত্মক দূর্গন্ধ, দূর্গন্ধটা সহ্য করার মতো না। এই গন্ধ আমি চিনি। লাশ পচা দূর্গন্ধ। আমি মেয়েটার ব্যাপারে কিছুটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হলাম যে মেয়েটা আসলেই বেচে আছে তো? আমি ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যে শেষ কবে মেয়েটার সাথে দেখো করেছেন?

তিনি বললেন আজকে বিকেলেই তিনি মেয়েকে খাবার দিয়েয়ে গিয়েছেন।

আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে এই অসম্ভব দূর্গন্ধটার কারনে কেবল আমারই অস্বস্তি হচ্ছে, রাইসা সহ বাকি সবাই স্বাভাবিক। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কোন দূর্গন্ধ পাচ্ছে কিনা। রাইসা বললো কই না তো। মানে সমস্যটার শুরু এখান থেকেই। 


আমি সবাই কে এখানেই দাড়াতে বললাম আর টর্চটা রাইসার হাতে দিলাম। তারপর দোতালায় রশিদ সাহেবেরে মেয়ের ঘর কোন দিকে জিজ্ঞেস করে সেদিকে পা বাড়ালাম। রাইসা বললো,

-ওপরেও তো আলো নেই, টর্চটা তুমি নিয়ে যাও আমরা না হয় মেবাইলের ফ্লাশ লাইট দিয়ে কাজ চালিয়ে নিবো।

আমি- না ওটার দরকার হবেনা।


আমি দোতালায় উঠে গেলাম, দোতালায় যতটা অন্ধকার হবে বলে আশা করে ছিলাম এখানে অন্ধকারটা তারচেয়ে অনেক বেশি। তবে রশিদ সাহেবের মেয়ের ঘরের দরজাটা হালকা খোলা, সেখান থেকে অতি ক্ষীন আলো আসছে। আমি গিয়ে ওই সামান্য খোলা দরজায় নক করলাম।

ভেতর থেকে উত্তর আসলো...

                                                                                   পরবর্তী পর্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ