অনুভূতি - ২ (পর্ব-৩)




অন্য কোন নেশা-ভাঙ করিনা। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি আলাদা। একটা ফার্মেসী থেকে দুই বোতল অ্যান্টিটাসিভ আর দু-পাতা সিডেটিভ জাতীয় ঘুমের ট্যাবলেট নিলাম, এইসব ঔষধ প্রেসক্রিপসন ছাড়া দেয়া হয়না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই হিসাব আলাদা, কিভাবে আলাদা তা না হয় নাই বা জানলেন । আপনারা হয়তো ভাবছেন এসব ঘুম ও তন্দ্রা আনায়ন কারী ঔষধ গিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে সারা রাত একলা ড্রাইভ করবো? নাহ্, ওসবে আমার কিচ্ছু হয়না। গাড়িতে চলতে থাকা মিউজিকের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটা ৯৬/৯৭ পার করে দিলাম ।


ভোরের দিকে বাসায় পৌছালাম, সরাসরি গোসল করতে চলে গেলাম। তখনই হলো একটা বড়ো ভুল। গোসল করে এসে গতকালের নোংরা কাপড় গুলো আমাদের নোংরা কাপড় রাখার কমন যে বিনটা আছে ওখানেই ফেলে রেখে সরাসরি বিছানায় গিয়ে পড়লাম। বিনটাতে রাইসার একটা অ্যাপ্রোনও ছিলো।


দুপুর ১২টার দিকে ঘুম ভাঙলো, রাইসা সম্ভাবতো ডিউটি শেষ করে বাসায় এসেছে। ও বিনে রাখা সব কাপড় ওয়াসিং মেশিনে দিয়ে কফি বানিয়ে আমাকে ডাকলো। ড্রইংরুমে টিভি দেখতে দেখতে ওর সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে গত রাতের সেই কাপড় পুড়িয়ে ফেলার কথা ভুলেই গেলাম।


রাইসার কাছে চট্টগ্রাম যাওয়ার ব্যাপারটা লুকাতে পারলাম না। মেয়েটার আই.কিউ ভালো। আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলো গতকাল রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

আমি- কেন বলোতো ?

  • আমি আসার সময় দেখলাম গাড়ির ড্রাইভারের সাইডের দরজা ঠিক ভাবে লাগানো নেই সামান্য খোলা, গাড়িতে চাবিও লাগানো আর ইঞ্জিনও গরম। খুব বেশি ক্লান্ত না থাকলে এক সাথে এতো গুলো ভুল তোমার করার কথা না !

আমি সাধারনত মিথ্যা কথা বলিনা। বললাম, চট্টগ্রামে পুরনো এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

  • তা আমাকে বলে গেলেই পারতে।

আমি বললাম হুট করে ডিসিসন নেওয়া তো তাই তোমাকে জানানো হয়নি।


ও আর কোন প্রশ্ন করলো না। ও আমার এমন অদ্ভুত কান্ডকারখানার সাথে পরিচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো মেয়েটা আমাকে বিশ্বাস করে।


এবার চলুন ফিরে যাই মূল ঘটনায়,


মর্গের দরজা খুলে খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু দেখলামনা, রাইসা একটা টেবিলে বসে কিছু কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে। তবে অস্বাভাবিক যেটা ছিলো সেটা হলো ওর পুরো অ্যাপ্রোনে পচা রক্ত মেখে একাকার কিন্তু সেদিকে ওর কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। ও স্বাভাবিক ভাবেই ওই কাগজ-পত্র গুলো নাড়াচাড়া করছিলো।


হঠাৎ আমাকে আর ডোম কে একসাথে দেখে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, তুমি কথন আসলে ? আর ডোম কে বললো

  • ভেতরে কেউ আছে কিনা সেটা দেখেতো তালা লাগাবে নাকি ?

ডোম বেচারা মাতা নিচু করে রইল !


তবে আমি কিন্ত ঠিকই রাইসার আচরনে অসংলগ্নতা লক্ষ্য করেছি। আর যখনি আমি মর্গের দরজা খুলেছি একটা প্রচন্ড অস্বস্তিকর গরম বাতাস আমার পাজরের দুপাশ ঘেষে যে বেরিয়ে গিয়েছিলো তা এই ঝড়-বাদলের রাতের ঠান্ডা আবহাওয়ায় আমার বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।


খুব অস্বস্তি লাগছে এখানে থাকতে। আমি রাইসার হাত ধরেটান দিতেই কিছুটা চমকে গেলাম, কারণ ওর হাত সব সময় এমনিতেই ঠান্ডা থাকে কিন্ত এখন ওর হত ভেজা থাকা সত্বেও অস্বাভাবিক গরম। কিন্তু চমকানোর অনুভুতিটি প্রকাশ করলাম না। এধরনের জায়গায় এ ধরনের অনুভুতি প্রকাশ করতে নেই। কারণ এসব জায়গায় যে অন্ধকার সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে আপনার একটা ভুল অনুভুতির প্রকাশই হয়ে উঠতে পারে ওই অন্ধকারে আপনার হারিয়ে যাওয়ার কারণ। ওই অন্ধকার বড় ক্ষুধার্ত। সব কিছু, সবাইকে গ্রাস করতে চায় সে। তবে আমার মতো পাত্তা না দিলে তার কিছুই করার থাকেনা, এই দিক থেকে জিনিসটাকে যদিও অসহায় বলা যায় কিন্তু পুরোপুরি না। 

তবে সব কিছুর মতো এসব ক্ষেত্রে ও অনাবিষ্কৃত লুপ হোল থাকে! আমি এখন সেটা নিয়ে নাড়া চাড়া করতে চাইনা। অন্তত রাইসাকে এই অবস্থায় সাথে নিয়ে তো না ই। সব জিনিস নিয়ে বাজি ধরা চলেনা।


রাইসা বললো একটু দাড়াও কাগজ গুলো গুছিয়ে রেখে আসি।

আমিও ওর সাথে সাথেই গেলাম। কাগজপত্র গুলো গুছােতে ওর দু-তিন মিনিট সময় লাগলো। তার ডোমের হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট টা নিয়ে একটা টান দিলাম আর মর্গের চাবিটা তার হতে দিয়ে আমি আর রাইসা বাসার উদ্বেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। 

এমনিতেই ঠান্ডাদিন তারওপর গাড়ির এ.সি ফুল ব্লাস্টে চালিয়ে রেখেছি কিন্তু ওই গরম অস্বস্তিকর অনুভুতিটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। তার ওপর গাড়ির ভেতরে আঁশটে পচা রক্তের দূর্গন্ধটা এতো বেড়েছে যে নিঃস্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

আপনাদেরকে বললাম না যে রাইসার ভিতরে আমি একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছি সেটা এখন আপনাদের নিকট বর্নণা করি। 

গাড়ির ভেতর আমার এরকম দম আটকানোর মতো পরিস্তিতি হলেও রাইসা দিব্বি সিট এলিয়ে দিয়ে গাড়ির মৃদু কেবিন লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে একটা বই পড়ছে। আমি বুঝতে পারছি যে এই দূর্গন্ধ আর  ওই গরম অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টির উৎস কোথায়?

রাইসার রক্তমাখা অ্যাপ্রোন আমি খালি একবার রিয়ার ভিউ মিররে একবার দেখলাম যে পেছনে কোন গাড়ি আছে নাকি। এ.সি ফুল ব্লাস্টে চলার কারনে আর আদ্র আবহওয়ার জন্য গাড়ির পেছনের কাঁচে ভাপ জমে গিয়ে সেদিকে দিয়ে কিছু দেখা গেলনা কিন্তু সেখানে যেহেতেু কোন আলো পড়ছেনা তার মানে ফিছনে কোন গাড়ি নেই। এই পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে আমার দেড় সেকেন্ড সময় লাগলো। আমি আর কোন কথা চিন্তা না করে সর্বশক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরলাম, এই অভিশপ্ত অন্ধকার আর সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া রাইসাকে নিয়ে আমি যাই হোক বাসায় ফিরছিনা ! প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তা স্লিপারী হয়ে যাওয়ায় গাড়ি মোটামুটি ১০-১৫ মিটার স্কিড করে দাঁড়ালো।

এতা কিছুযে হয়ে গেলো তাতে রাইসার কোন ভ্রক্ষেপই নেই, খালি এটুকু জিজ্ঞেস করলো কি হলো আবার!!?


আমি ব্রেক ধরেছি র‌্যাডিসন ব্লু’র সামনে, আমি এ.সি বন্ধ করে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম । সাথে সাথেই বৃষ্টির পানি এসে লাগলো গায়ে। সাথে সাথেই গাড়ি ভিতরের ওই ভ্যাপসা আবহাওয়া আর আমার ওই অস্বস্তিকর অনুভুতিটা যেন খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। 

রাইসার মধ্যেও এখন সেই অস্বাভাবিকতাটা নেই একটা জিনিস ছাড়া ৬৫ - ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় চলমান গাড়ি আচমকা ব্রেক কষায় সে তেমন কিছুই বলেনি কিন্ত এই জানালার কাঁচ নামানোয় সে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি শুধু ধারণা করলম যে এতক্ষন ও ওর মধ্যে ছিলোনা যদিও এটা জাস্ট ধারণা এরকম বৃষ্টির মধ্যে কারন ছাড়া এতো দ্রুতগামী একটা গাড়ি থামিয়ে এরকম ভারী বৃষ্টির মধ্যে জানালার কাঁচ খুলে দিলে যে কারোরই অবাক হওয়ার কথা, প্রথম বার হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি হয়তো ভেবেছে কারণ আছে বলেই আমি ব্রেক কষেছি কিন্ত আমার প্রশ্ন হলো একবারকি উঠে (সিট এলিয়ে দিয়ে ও বই পড়ছিলো) দেখা উচিত ছিলোনা যে কেন আমি এমনটা করলাম? 

আমি হুট করেই ওর হাতটা ধরে বললাম, 

  • রাইসা, চলোনা আজকে বৃষ্টিতে ভিজবো !

আমি এমনিতে রোমান্টিক কিসিমের লোক না, আমার মুখে এই কথা শুনে রাইসা অবাক হওয়ার শেষ মাত্রায় পৌছে ঘড়ি দেখে বললো 

রাইসা- কয়টা বাজে জানো ?


এরই মধ্যে পেছন থেকে এক বেরসিক গাড়ি এসে ব্লিংক দিয়ে হর্ণ বাজাতে শুরু করেছে। আরে শালার বেটা ডানে ফুটবল মাঠের মতো জায়গা খালি পড়ে আছে চাইলে Dash 8-400 এয়ারক্রাফট অনায়েশে ল্যান্ড করতে বা উড়ে যেতে পারবে আর না এ শালাকে এদিক দিয়েই যেতে হবে!

আমি সাধারণত খুব সহজে রাগিনা কিন্তু আজকে সহ্য হলোনা। দরজাটা খুলে বেরিয়ে গিয়ে (রাইসা যদিও আটকাতে চেয়েছিলো) গড়ির পিছন থেকে স্টেইনলেস স্টিলের রড টা বের করতেই বদমাইস ডান সাইড দিয়ে পালালো। ইচ্ছা ছিলো শালার গাড়ির হেডলাইট দুইটা ভাঙবো, এমনিতেই হাই-বিমে গাড়ি চালানো ড্রাইভারদের সহ্য করতে পারিনা আর এ আবার হাই-বিমের ওপর ব্লিংক দিচ্ছিলো, হর্ণের কথা না হয় বাদই দিলাম!

আমি গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে একটু নিচু হয়ে ঝুকে রাইসাকে বললাম

-আজ না হয় ঘড়িটা ৩টা ২০ এ আটকে থাক, যাবে আমার সাথে আপেক্ষিক সময়ের উর্ধে ?

রাইসা খালি আমার হতে ধরা স্টেইনলেস স্টিলের রড টা দেখিয়ে বললো,

-এটা দিয়ে আর কয়জনকে তাড়াবে ? এইটা হাইওয়ে !

আমার ওর উত্তর বুঝতে আর বাকি থাকলোনা, তাই গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেলাম ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে।

এতক্ষনে রাইসা ওর অ্যাপ্রোনের দিকে খেয়াল করে বললো

-ছি, এটার এই অবস্থা হলো কি করে? তুমি আমাকে বলবেনা, পুরো গাড়িটা দূর্গন্ধে ভরে গিয়েছে!?


ওর অ্যাপ্রোনের কথাটা তখন ওকে বলিনি কারণ বিষয়টা ওর নিজেরই বুঝতে পারার কথা বরং আমার চেয়ে অনেক আগেই ওর নজরে আসার কথা। এসব বিষয়ে ও আমার থেকে অনেক বেশী সেন্সিটিভ তার পরেও যখন দেখেছি যে ও বিষয়টা আমলে নিচ্ছেনা তাই আমিও আর এটা নিয়ে ওকে ঘাটাইনি তাছড়া মূল কথা হলো ওই মর্গের আশে পাশে আমি এমন কিছু উচ্চারণও করতে চাইনি যেটা ওই অভিশপ্ত অন্ধকারকে ট্রিগার করে। ওই স্থানটা আমার, আমাদের অনুকুল্য নয়। তবে এই জিনিস টা ওর থেকে চিরতরে আলদা করতে হবে এটা আমার মাথায় ছিলো আর কিভাবে করবো তার একটা পরিকল্পনাও আমি একটু আগেই করেছি যার বাস্তবায়নের একটা অংশ এই ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে রাত দুপুরে ভিজতে আশা (আমি আগেই বলেছি আমি রোমান্টিক কিসিমের লোক না)।


আমি বললাম- খেয়াল করিনি। আচ্ছা চলো, প্লাটফর্মের দিকে যাই। (ও জানেই যে আমি একটু বেখেয়ালি টাইপের লোক তাই আর কোন কথা বাড়ালো না)

রাইসা- এই অ্যাপ্রোনটার কি করবো ?

আমি- গাড়ির ভেতরেই রেখে দাও। পরে দেখা যাবে !

রাইসা- এটা গাড়ির ভিতরে রেখে গেলে দূর্গন্ধে গাড়ির ভেতরে আর বসা যাবেনা।

আমি ওকে ওটা ভাজ করে গাড়ির ছিনের বুটের ওপর রেখে দিতে বললাম ।

তো ওটা ওখানে রেখে আর রাইসা প্লাটফর্মের দিকে যেতে লাগলাম, আমি ওর হাতটা ধরলাম। অনেক দিনে এভাবে ওর হাত ধরে হাটা হয়নি, ও কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। ওর চোখ দুটো পরিষ্কার দেখতে পেলামনা কারণ সেই প্রথম দিনের মতো আজও চশমা পরা আর সেদিনকার মতো আজো ওর চশমায় বৃষ্টির পানি, আমি বুঝিনা বৃষ্টির মধ্যেও এই মেয়ে চশমা খোলেনা কেন! চশমা আমারো আছে তবে আমি সেটা গাড়িতেই রেখে এসেছি।


আমরা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের মাঝখানের প্লাটফর্মে বসলাম। আপনারা যারা ওখানে গিয়েছেন তারা জানেন যে মাঝখানের প্লাটফর্মে দু-তিনটা মতো সিমেন্টের উচু জায়গা আছে, আগে সম্ভবত ল্যাম্পপোস্টের গোড়া ছিলো এখন গোড়া আছে কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট নাই তাই সেগুলোকে এক প্রকার টুলের মতো ব্যাবহার করা যায়।

ওগুলোর একটাতে রাইসাকে বসালাম আর আমি ওর দিকে মুখ করে নিচে বসলাম, ও অনেক জোরাজোরি করলো ওর পাশে বসার জন্য কিন্তু ওখানে দুজনের জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই তবে বসা যেত। আমি বসলামনা কারন আজ আমি ওকে দেখবো, সত্যি বলতে কি ওকে সেভাবে কখনো দেখা হয়নি। আসলে নিজের সাথের অভিশপ্ত অন্ধকার জগৎটা সেই সুযোগটা আমাকে দেয়নি!


আমি রাইসাকে বললাাম চশমাটা আমাকে দাও তো। আজ আমার আর ওর দৃষ্টির মাঝে আমি অন্য কিছুর অস্তিত্ব চাইনা। আমি বনে-জঙ্গলে গাড়ি থামিয়ে, ফেরী পারাপার হওয়ার সময় পদ্মা নদীর মাঝ থেকে চাঁদ দেখেছি কিন্তু আমার গাড়ির সেকেন্ড সিটে যে চাঁদটা থাকে সেটা কখনো খেয়ালই করিনি। আসলে মানুষ কোন কিছু পেয়ে গেলে সেটার কদর করতে ভুলে যায়, আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

আমি সরাসরি ওর চেখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকায় ওর অস্বস্তি হওয়ায় ও বললো

  • এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ?

আমি- দেখছি।

  • আগে কোনদিন দেখনি নাকি ?

আমি বললাম দেখেছি কিন্তু কখনো এভাবে দেখা হয়নি, তোমাকে দেখতে দেখতে কখনো ভাবা হয়নি যে তুমি শুধুমাত্র আমার। ভাবা হয়নি কি অমুল্য রত্ন আল্লাহ্ আমাকে দান করেছেন! আজ এ সব কিছু ভেবে বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত প্রসান্তি অনুভূত হচ্ছে। তুমি আমার পরিপূর্ণতা!


আমার কথা শুনে ওর মধ্যে কি অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছে তা আমি জানিনা। রাইসা সেই বিশেষ মানুষ গুলোর মধ্যে একজন যার চিন্তাধারা আমি পড়তে পারিনা, তাছাড়া দু-চারটা বাক্য বিনিময়ের পরই আমি প্রায় ৯৭% মানুষের চিন্তা-ধারাই সম্পূর্ণ পড়ে ফেলতে পারি এমনকি এটাও বলে দিতে পারি যে কারো সাথে একটা নিদিৃষ্ট সংলাপের মধ্যে আমার প্রতিটি কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে কি বলবে। কিন্ত বাকি ৩% ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। রাইসা ওই  ৩% এর অন্তর্ভুক্ত, এদের মস্তিষ্কের মধ্যে কি চলছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমান করা যায়না ! 

আমিও বেশিক্ষন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম না, কারণ ওই চোখে ওভাবে তাকিয়ে থাকলে হারিয়ে যাবো ওই চোখের মধ্যেই। যদি হারিয়ে যেতাম তাতেও অবশ্য কোন ক্ষতি ছিলো না। 

তবে এখন হারিয়ে যাওয়ার সময় না তা মনে করিযে দিলো খুব পরিচিত একটা আতরের সুগন্ধ। খুব পরিচিত হলেও কিছুতেই মনে করতে পারছিনা যে কোথায় এর আগে এই আতরের সুগন্ধ পেযেছিলাম ! 

রাইসা ও বললো যে, 

  • একটা সুগন্ধ পাচ্ছো, কোথা থেকে আসছে বলোতো এখনেও আমরা ছাড়া কেউ নেই ?

আমি বললাম- আসছে হয়তো কোথাও থেকে। তাছাড়া মাঝের রেললাইনের ওপারে রেলওয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের ঘর। আর এখন ফজরের নামাজের সময়ও হয়ে এসেছে প্রায়, উনি আজান দেওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন হয়তো। (ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে ইমাম সাহেব মুয়াজ্জিনের দ্বায়ীত্ব পালন করেন)

রাইসা বললো- তাহলে তো ভোর হওয়ার সময় হয়েই গিয়েছে চলো বাসার দিকে যাই।


ওর কথা শুনে আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমি স্তব্ধ হয়ে হয়ে গেলাম, কারণ আমার ঘড়িতে এখন সময় দেখাচ্ছে ৩টা বেজে ২০ মিনিট। মানে এখানেও একটা টাইম ম্যানুপুলেশনের মধ্যে আছি আমরা কিন্তু এখনকার অনুভুতিটা আলাদা অত্যন্ত স্নিগ্ধ, সেই শীতল শুভ্র আলোর মত আনুভুতি। রাইসা যেহেতু ঘড়ি দেখেনি তাই এই টাইমের ম্যানুপুলেশনের ব্যাপারটা ওর নজরে আসেনি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ যেন ইচ্ছে করেই বিষয়টা ওর নজরে আনেনি এবং আমিও চাইনা যে বিষয়টা ওর নজরে আসুক।


আমরা যতই গাড়ির দিকে এগুচ্ছিলাম আতরের ঘ্রানটা ততোই বাড়ছিলো, তো গাড়ির কাছে এসে আমরা দুজনেই তাজ্জব বনে গেলাম,

রাইসার আ্যাপ্রোনটা আগুনে জ্বলছে, এখানে অবাক হওয়ার বেশ কয়েকটা কারণ আছে যেমন,

আগুনটা ধরালো কে, যদি কেউ আগুন ধরিয়েই থাকে তাহলেও আ্যাপ্রেন টা পুরোই ভেজা ছিলো এমন একটা ভেজা কাপড়ে আগুন ধরালো কিভাবে? অক্টেন বা তীব্র দাহ্য কোন পদার্থ দিয়ে যদওি আগুন ধরানো সম্ভব কিন্ত এমন ভারী বৃষ্টির মধ্যে আগুনটা জ্বলছে কিভাবে? আমি আর রাইসা দ্রুত পা চালিয়ে কাছে গিয়ে আরো অবাক হলাম এটা দেখে যে এই আগুনটার কোন উত্তাপ নেই। এবার আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলাম, এই ধরনের ঘটনার সাথে আমি অভ্যস্থ কিন্তু রাইসা বেশটা ভয় পেয়েছে (আমি আয়াত-উল-কুরসি পড়ে ওর বুকে ফু দিলাম, কারণ ভালো খারাপ যাই হোক আমি চাইনা তা ওর কাছ পর্যন্ত পৌছাক।)

আমি বিষয়টা আরো ভালো ভাবে উপলব্ধি করার জন্য জ্বলন্ত অ্যাপ্রোনটার কাছে গিয়ে ঝুকে বসলাম, তারপর খুব ধীরে হাতটা বাড়ালাম ওই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে।

রাইসা আৎকে উঠে আমার হাত চেপে ধরে বললো,

  • কি করছো, পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি? হাত পুড়ে যাবে তো !


আমি রাইসাকে বাম হাত দিয়ে আটকালাম আর ডান হাত দিয়ে ওকে চুপ করার ইশারা দিয়ে আবার ডান হাতটা ওই আগুনের মধ্যে দিলাম। রাইসা অত্যন্ত আতংকিত হয়ে আমার এই কান্ড কারখানা দেখেছে, ওর চোখে বিশ্ময়ের ছাপ স্পষ্ট । বিশ্মিত হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণ আগুনে অ্যাপ্রোনট পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কিন্ত আমার হাতের কিছু হচ্ছেনা। আগুনটার রং ও কিছুটা অদ্ভুত কারণ আগুনটা পুরোপুরি হলদেটে না কিছুটা নীলাভ-সাদা। দেখতে দেখেতে অ্যাপ্রোনটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো আগুনটাও নিভে গেল।


খেয়াল করলাম আমাদের পেছনে কেউ একজন এসে দাড়িয়েছে, আর আতরের ঘ্রানের উৎস তিনিই। পেছন ঘুরেই তার দিকে তাকাতেই চিনতে পারলাম। ইনি সেই চাচা।

সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? এই অসময়ে এখানে?

সালামের উত্তর দিয়ে চাচা বললেন, আমার আর সময় আর অসময় ! আইজ যামু চট্টগ্রাম, ভোরের ট্রেনে। কমলাপুরের দিকে যাইতেছিলাম, এইখানে তোমাদের দেখতে পাইয়া কাছে আইলাম।

রাইসার দিকে ইসারা করে বললেন আম্মাজান বুঝি তোমার বৌ ?


আমি উত্তর দিলাম জ্বী চাচা। ( আমার কেনজানি মনে হচ্ছে এই চাচা সবই জানেন কিন্তু পরিস্তিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রশ্ন গুলো করে যাচ্ছেন এবং এই আগুন ধরানোর কান্ড ইনি নিজেই ঘটিয়েছেন। )


উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, তোমারে আল্লাহ্’ই একটা না বেশ কয়েকটা বিশেষ গুণ দিছেন। ওইগুলা মাইনষের ভালোর লাইগা কামে লাগাইও অনেক দোয়া পাইবা, সওযাব পাইবা।


আমি বললাম -আপনি ঠিক কিসের কথা বোঝাতে চাইছেন আমি কিন্তু বুঝিনি।

চাচা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, এইযে তুমি আমার মনের কথা পইড়া ফেলতেস এইটারে কি বলবা ? 

তারপর তিনি আমাকে হাত বাড়াতে বললেন, সেই দিনকার মতো একটু আতর ঢেলে দিলেন তবে আজকের আতরের পরিমানটা একটু বেশী মনে হলো। তারপর বললেন আতরটা রাইসার গায়ে মেখে দিতে। তারপর তড়িঘড়ি করে বললেন 


  • অনেক দুর হাইটা যাইতে হইবো আমি যাইগা। আম্মাজানের খেয়াল রাইখো আর আতরটা তাড়াতাড়ি দিয়া দাও, উইড়া যাইবো আমি গেলাম, আল্লাহ্ হাফেজ।


আমি গিয়ে আতরটা রাইসার গায়ে লাগিয়ে দিলাম। এতক্ষন পুতুলের মতো দাড়িয়ে থাকার পর ও নিরবতা ভেঙে বললো,

  • আসলে আমাদের সাথে কি হচ্ছে একটু বুঝিয়ে বলবে? আর উনি কে?


এখন আমি নিজের একটা দূর্বলতা খুজে পেলাম সেটা হলো আমাদের সাথে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে সেটা ওকে বুঝিয়ে বলার মতো ভাষা আমার জানা নেই, আসলে আমি নিজেই এখনো জানিনা এসব কি হচ্ছে আর কেন হচ্ছে? তাই আমি রাইসাকে খালি ওই চাচার সাথে প্রথমে কিভাবে পরিচয় হয়েছিলো তা মনে করিয়ে দিতে দিতে গাড়ি স্টার্ট করে বাসার দিকে যেতে লাগলাম। 

সব শুনে রাইসা বললো,

  • আজ তো উনাকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারতে বা হাতে কিছু টাকা দিয়ে কোন বাসে তুলে দিতে

পারতে, আজতো গাড়িতে ফুয়েলও ছিলো হাতে টাকাও ছিলো।


আমি রাইসার কাছে কোনকিছু লুকোতে পছন্দ করিনা, আমি চাইনা আমাদের দুজনের মধ্যে কোন পর্দা থাক। খালি অভিশপ্ত অন্ধকার গুলোকে ওর কাছ থেকে চেপে যাই। তাই বলেই দিলাম,


  • উনি টাকা বা লিফট কোনটার জন্যই আমাদের কাছে এখানে আসেন নি। তোমার মনেহয় তাপহীন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অ্যাপ্রোনটার কথা এখন খেয়ালে নেই! আমার যতদুর মনে হয় ওই কাজ টা উনারই।

রাইসা সিটবেল্ট খুলে একবারে বাচ্চা মেয়েদের মতো আমার দিকে ঘুরে বসে বললো,

  • হ্যা, হ্যা আমি ওটা নিয়েই প্রশ্ন করবো ভাবছিলাম। আমাকে পুরোটা খুলে বলবে?

আমি- আমি নিজেই সেটা এখনো জানিনা। জানতে পারলেই তোমাকে জানাবো।


কিছুক্ষনের মধ্যেই...


পরবর্তী পর্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ