ভ্রম কিন্ত বাস্তব


রেল লাইন ধরে হাটছি । আশে পাশে তেমন কোন আলো নেই, তবে আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ আছে তাই পথ দেখতে অসুবিধা হচ্ছেনা । ঘন্টা খানেক পর একটা ইন্টারসিটি ট্রেন আছে । হাতে একটা সিগারেট জ্বলছে, যদিও একজন না করেছে কিন্তু নিজের জীবনের শেষ কয়েক ঘন্টায় কিছু নিষেধাজ্ঞা না মানলে হয়তো তেমন দোষের কিছু হবে না, মানে আমি এখানে আমার জীবনের একটা ফুলস্টপ, না আজ সহজ ভাষায় বলি। আত্মহত্যা করতে এসেছি। হুমম আমি কিন্তু নিজেকে খুব অপটিমিস্টিক লোক হিসেবে দাবী করি, মানসিকতার দিক থেকেও বেশ শক্ত। তথাকথিত ব্রেকআপ বা প্রেমে ব্যার্থ হয়ে আত্মহত্যা করতে আশার মতো লোক আমি নই, অর্থাৎ কারণ একটা আছেই এবং আমার মতে তা যথেষ্ট গুরতর। অবশ্য সকল আত্মহত্যাকারীর কাছেই তার আত্মহত্যা করার করন গুরুতর। আমার পুরো অতীত জীবন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । সেখানে সুখকর ঘটনার সংখ্যা খুব কমই । সেদিন শখ করে একটা ঘড়ি কিনেছিলাম, সেটাতে সময় দেখলাম রাত ১০:৪৫। ট্রেনটা আশতে আর খুব বেশি দেরী নেই। তো আমার থেকে কিছুটা সামনে একটা মানুষের অবয়ব খেয়াল করলাম। আরো কিছুটা এগুতে বুঝলাম একটা মেয়ে বসে আছে। এতো রাতে রেললাইনের এই জায়গায় কোন মানুষেরই আশার কথা না, সেখানে একটা মেয়ে এখানে কি করছে । তবে কি…? কিছুটা দ্রুত হেটে কাছে যেতেই হতচকিত হয়ে গেলাম ।

নওরীন !!!

 

যখন নবম-দশম শ্রেণীতে পড়তাম তখন একটা মেয়েকে কল্পনা করতাম, মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতাম, নওরীনকে । কিন্তু ও তো কল্পনা তাহলে এ কে । আমি কিছু বলার আগেই বললো

– পরিবেশটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে তাইনা ?

আমি বললাম তা আছে, কিন্তু আপনি কে ? এতো রাতে এখানে কি করছেন ?

সে নিজের পরিচয় না দিয়েই বললো চাঁদের আলো আমার খুব পছন্দ, এরকম পরিবেশে আমি প্রায়ই আসি আপনি খেয়াল করেন না আর আজ পরিস্থিতিটা এরকম যে আমাকে আাসতেই হতো ।

আমি – আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আপনাকে একটা প্রশ্ন না করে পারছিনা ।

– করুন কি প্রশ্ন করবেন ?

আমি – আমি আপনার সাথে কোন একজনের খুব মিল পাচ্ছি, আপনার কথাবলার ধরনটাও সেরকম । আপনি কে আর আপনর উদ্দেশ্য কি ?

সে- কারো সাথে কারো মিল থাকতেই পারে সেটাকি অস্বাভাবিক ?

আমি- না সেটা অস্বাভাবিক নয় তবে তার সাথে যোগসুত্র ও বর্তমান ঘটনা প্রবাহটা আমার কাছে স্বাভাবিক নয় ।

– সহজ ভাষায় বলুন । এরকম কঠিন কথা আমি বুঝতে পারিনা ।

আমি – আপনিও কিন্তু খুব একটা সহজ ভাষায় বলেন নি।

সে- কিন্তু আপনি কিন্তু আমার কথাটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন।

সে যাই হোক আপনি কে ?

-নাম বললে চিনবেন ?

শুধু নাম বললে যদি চিনতেই পারতাম তাহলে আগেই চিনতে পারার কথা ।

– নওরীন, এর পর নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন এটা কিভাবে সম্ভব ? আর আগেই জানতে চেয়েছেন এত রাতে আমি এখানে কি করছি ?।

– না, কিভাবে সম্ভব সেটা জানতে চাইবো না । সম্ভব অসম্ভবের সঙ্গাটাই আমার কছে এখন যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ও মুল্যহীন ।

আমি ওপর ওপর খুব শক্ত শক্ত ভাব ধরে থাকলেও আমি কিন্তু ভিতর ভিতর যথেষ্ট ভড়কে গেছি ।

মরতে এসে ভড়কে যাওয়া ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না কিন্তু আমি যে কারনে ভড়কে গিয়েছি সেটা অস্বাভাবিক ।

এখন এই মুহূর্তে আমার চার পাশের পরিবেশ, এই লোহার রেললাইন পুরো জগৎ কে আমার একটা অস্তিত্বহীন হলোগ্রাফিক ইমেজ মনে হচ্ছে। যা দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার অস্তিত্ব নেই। হঠাৎ আমি রেললাইনের স্লিপারে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গেলে ও সাথে সাথেই আমাকে ধরে সামলে নিলো, ওর হাতটা অদ্ভুত রকমের শীতল। যে শীতলতা স্নায়ুতে আঘাত করেনা কিন্তু একটা অপার্থিব প্রশান্তি দেয় তেমন শীতল। ও আমাকে ছোঁয়ার সাথে সাথেই আমার অনুভূতি, চারপাশের পরিবেশ কেমন বদলে যেতে লাগলো।

আমি বুঝতে পারছি যে আমার মস্তিষ্ক এখন তার প্রসেস করার ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে, অনেকটা সি.পি.ইউ ওভারক্লকিং এর মতো । ধীরে আমার পরিপার্শ্বিক অদ্ভুত ভাবে বদলে গেলো । কেন যেন রাতের আকাশটাকে কালো মনে হচ্ছেনা,অন্ধকারটাও সামান্য স্তিমিত হয়ে একটা নীলাভ আলোকিত অন্ধকাররে সৃষ্টি করেছে । নীলচে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে হীরের মতো তারা খচিত । রেল লাইনের দু-ধারে বিশাল ফসলি মাঠ । আমি নওরীনকে দেখলাম ও বেশ স্বাভাবিকই আছে যেনে এমনটাই হওয়ার ছিলো । ঠিক কতটা সময় নিয়ে আমার মস্তিষ্ক ব্যাপারটা প্রসেস করলো তা বুঝতে পারলাম না, কারন ঘড়িটা ১০:৪৫ এ আটকে গিয়েছে ।

নওরীন বললো, আপনি কি ভাবছেন আপনি এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছেন ?

আমি বললাম সেটাইতো মনে হয় ।

– না তা নয়

– মানে?

– আপনার অবচেতন মন আপনাকে এখানে এনে দাড় করিয়েছে এবং তা আত্মহত্যা করার জন্য নয় !

ধীরে ধীরে আমার কাছে এই ভ্রমটা পরিষ্কার হচ্ছে, যেন বিভোর নেশার সুতো একটা একটা করে কেটে যাচ্ছে ।

আমি আমার কল্পনাকে ছুঁয়েছি, (নওরীনকে) নিজের কল্পনাকে ছুয়ে দেখার সৌভাগ্য সবার হয়না ।

আমি নওরীনের দিকে তাকিয়ে আছি, কল্পনা এতটা নিখুঁত হতে পারে আমি জানতামনা ।

ইচ্ছে হচ্ছিলো যে এই ভ্রম যেন কখনো না কাটে । কালের পর কাল ওর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকি ।

এভাবে কতটা সময় পার হয়ে গেল জানিনা।

নওরীন বললো, কল্পনা গুলো যতটা যত্ন করে সাজিয়েছেন একবারও কি ভেবেছেন সেটার বাস্তব রুপ কতটা সুন্দর হতে পারে ?

আমি আসলে কখনো কল্পনাই করিনি যে এটা বাস্তব রুপও নিতে পারে ।

নওরীন বললো দেখেন আপনি নিজেই কল্পনা ও বাস্তবতা তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন বলে হাসতে লাগলো, এ হাসি কোন সাধারন হাসি না, এর মধ্যে অপার্থিব কিছু আছে। হাসি থামিয়ে নওরীন বললো আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, হোচট খেয়ে আপনি আপনার মোবাইলটা ১১০/৭ নম্বর খুটির কাছে ফেলে এসেছেন ওটা আবার নিয়ে যেতে ভুলবেন না, আপনার যা ভুলো মন বলে সেই অপার্থিব হাসি হাসতে লাগলো ।

হঠাৎ মাথাটা ঝিম ধরে গেলো, আমার হাত ঘড়িটা আবার চলতে শুরু করেছে, কিন্তু সে এক অস্বাভাবিক গতিতে প্রচন্ড ঘুম আসছে……

 

মুখে পানির ছিটা পড়ায় ঘুম ভাঙলো । চোখ খুলে দেখলাম সামনের রেলওয়ে মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব । উনি ফজরের আজান দিতে যাওয়ার পথে আমাকে রেললাইনের পাশে দেখতে পেয়েছেন ।

 

আমি হুড়মুড় করে উঠেই সেই ১১০/৭ নম্বর খুটির কাছে গেলাম,

হ্যা

মোবাইলটা ওখানেই পড়ে ছিলো ।

 

তারপর মুয়াজ্জিন সাহেবের সাথে মসজিদে গেলাম উনি আজান দিলেন । অজু করে নমাজ পড়ার পর রেলওয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখলাম চায়ের টং দোকানটা সবে মাত্র খুলছে৷

গিয়ে বসলাম এক কাপ চা ও সিগারেট খাবো বলে।

মস্তিষ্ক পুরো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কোথায় সেই রাত ১০:৪৫ এর ট্রেন, এতোটা সময় কিভাবে পার হলো কিছুই মাথায় কাজ করছে না।

তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো গতকাল রাতের আত্মহত্যা করাকরার যে মানসিকতাটা তৈরী হয়েছিলো সেটা এখন একেবারেই নেই !

হঠাৎ করেই যেন সামনের আশার সকল দরজা আল্লাহ্ খুলে দিয়েছেন ।

 

চায়ে চুমুক দিয়ে সবে সিগারেটে প্রথম টান টা দিয়েছি, হুট করে সামনে একটা মেয়ে এসে হাজির । এসেই বললো ভোরের ট্রেনটা কি আজ দেরী করে আসবে ?

কন্ঠটা শুনে আমি থমকে গেলাম !

মেয়েটা যেভাবে হুশ করে এসেছে তাতে ওর চুলগুলো মুখের সামনে চলে এসেছিলো ।

চুলগুলো সরিয়ে ঠিক করতেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম !

আমি বললাম আপনার টিকেটটা দেখি ।

 

নওরীন

 

যাত্রীর নামের জাগায় প্রিন্ট করা, ঢাকার টিকেট !

আমি শুধু বললাম, না দেরী করবেনা, সঠিক সময়েই আসবে…. বলতে বলতে ছুট টিলাম টিকেট কাউন্টার মাস্টারের রুমের দিকে,

আমাকে ঢাকার টিকেট কাটতে হবে।

কল্পনাকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার সুযোগ বার বার আসেনা……..



 WRITTEN BY TANYM BARAKAH
MAY 21, 2022

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ