অনেক দিন পর লিখতে বসলাম, আসলে সময় হয়না । জীবনটা যেভাবে চলতে শুরু করেছিলো তার একটা উদাহরণ দেই, যেন একটা প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি, ভয়ানক প্রাকিৃতিক দুর্যোগ পূর্ণ আবহওয়ায় দূর্বার গতিতে ছুটে চলা হেডলাইট বিহীন ট্রেনের চালক আমি, বজ্রপাতের আলোর ঝলকানিতে দেখা যাচ্ছে লাইনের পাশে দাড়িয়ে রেলে কাটা পড়া ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস লাশ গুলো দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । এই নগরীতে কেউ নেই, সবাই দূর্যোগের পূর্বাভাস শুনে পালিয়েছে বহুদূরের নিরাপদ আশ্রয়ে । কিন্তু আমি এই অন্ধকারআচ্ছন্ন হেডলাইট বিহীন ট্রেন নিয়ে প্রচন্ডগতিতে কেবল ছুটে চলেছি, জানিনা শেষ কোথায় ! লাশ গুলো হাত নেড়ে ইশারা করছে আর আমি ধেয়ে ধেয়ে চলেছি আমার ১৫০০ অশ্বশক্তি সম্পন্ন সহস্র টন ওজনের এই ট্রেন নিয়ে, হয়তো সোনালী ভোরের আশায়…. এভাবেই চলছিলো,
একদিন আমার এক দূর সম্পর্কের চাচা কে নিয়ে ভর্তি হতে হলো একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । সম্ভাবত চার কি পাঁচতলার একটি ওয়ার্ডে । চার কি পাঁচদিন সেখানে একটানা থাকতে হয়েছিলো । ওয়ার্ডে থাকর মতো পরিস্থিতি ছিলোনা তবে ওয়ার্ডের পাশের উন্মুক্ত ছাদে বেশটা জায়গা ছিলো। সেসময় বেসটা গরম পড়েছিল। হাসপাতাল তার বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হবে করিডর অর্থাৎ ছাদের খোলা অংশ তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে ওই একই ভবনের আটতলা একটি অংশ। সেখানে উক্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল। আর সেই হোস্টেলের বারান্দা ছিলো ওই ছাদের দিকে। আমি ওই ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতাম, আবার কখনোবা সেখানকার একটা উুচু স্থানে সিগারেট হাতে শুয়ে তারা দেখতাম। আর একটা মেয়ে (ছাত্রী) ওই বারান্দায় বই নিয়ে বসে পড়তো। সেখান থেকে আমাকে দেখা গেলেও চোখাচোখি হওয়া সম্ভব ছিলোনা। কারন বারান্দাটা আরো তিন তলার ওপরে ছিলো।
আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা কোনটাই আমি সহ্য করতে পারিনা। আর সেখানে ঘুমোনোর কোন উপায় ছিলো না, প্রচন্ড মশা ও গরম। তো আমি গিয়ে ঘুমাতাম মানে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম আর সিগারেট ফুকতাম একটা এসির ঘরম হাওয়া বের হওয়া ব্লাস্ট ভেন্টের সামনে, সেখানে হাওয়ার তোড়ে মশা আসতে পারতো না কিন্তু বাতাস তো গরম, যার পরিপ্রেক্ষিতে মাথাব্যথাটা শুরু হয়ে গেল ঠিকই কিন্ত সিগারেটের আগুন নিভলোনা, তার সাথেই শুরু হলো বমি।
ওপরের মেয়েটা যে আমাকে খেয়াল করছে তা আমি বুঝিনি বা বোঝার মতো পরিস্থিতিও ছিলোনা। তা, বমির পর আবার কোন মতে হেলান দিয়ে আবার ভাটা চালু করলাম (বুঝতে পেরেছেন আশা করি)। এরই মধ্যে কখন যে একটা এপ্রোন পরা মেয় পাশে এসে দাড়িয়েছে খেয়াল করিনি৷ মেয়েটা আমি কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হাত থেকে সিগারেটা নিয়ে ফেলে দিলো। আর আমি কে, এখানে কি করছি জিজ্ঞেস করলো। আমি এই উত্তর দিতে শুর করবো কি মুখটা ঘোরানোর সুযোগও পেলাম না ওর গায়ের ওপরই পেটের অবশিষ্ট খাদ্য বিসর্জন দিলাম আর তার সাথে সাথেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। প্রায় মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম মেয়েটা ধরে ফেললো। এতো কিছুর মধ্যেও মেয়েটির ব্যাবহৃত পারফিউম আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় এড়ালো না। চাচার ওয়ার্ডের মধ্যেদিয়েই ওর কাঁধের ওপর হাত দিয়ে নিয়ে গেলো, চাচা একবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আমার কিছু বলতে রুচি হলোনা আর ও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।
নিয়ে গেল একটা এ.সি কেবিনে, একটা স্যালাইন সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলো (মানে ও ভালোই খেয়াল করেছিলো আমি গত চারদিন যাবৎ ঘুমাইনি) আর আমার ফোনে ওর নম্বরটা সেভ করে দিয়ে চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, ভোরের দিকে ওকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলাম। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। ঘুম ভেঙে গেলো। আমার জীবনের নতুন একটা ভোর, যেরকম ভোর এর আগে কখনো হয়নি আমার জীবনে। এখন বিল নিয়ে পড়লাম দুঃশ্চিন্তায়, অত টাকা তখন আমার কাছে নেই৷ তার পরেও গেলাম কাউন্টারে। ওখানকার দ্বায়িত্বরত নার্স বললো আপনার বিলে আপা দিয়ে গিয়েছেন। তখন ওর মোবাইল নম্বরের কথা মনে হলো। কল করলাম নম্বরটাতে৷
ও, ওর নাম কাইনাত। এই নামেই সেভ করা ছিলো নম্বরটা। কাইনাত বললো ওর ক্লাস আছে, যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে বিকেলে ওকে কল করতে পারি। সারাটা সময় ওর সাথে একটি বার দেখাকরার জন্য অস্থির হয়ে থাকলাম। রাতের ঘুমের ইঞ্জেকশনের প্রভাব তখনো পুরোপুরি কাটেনি। হাসপাতালের একটা অংশে বসে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেলাম। না, ওকে কল করতে হয়নি। আড়াইটা তিনটার দিকে ও নিজেই এসে ডেকে তুললো। আমার মনে হলো আমার ওই দূর্যোগের রাত যেন কাটতে চলেছে, কাইনাতই যেন আমার সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত নতুন ভোরের সূর্য।
ও আমাকে নিয়েগেল ক্যাফেটেরিয়ায়, নিজের হাতে রান্না করা নুডলস আমাকে খেতে দিয়ে বললো সারা দিন তো কিছু খাননি। আমি কথা না বাড়িয়ে মুচকি হাসি বিনিময় করে খেতে লাগলাম, আর মনে মনে ভাবছিলাম আমার ওকে চাই, যেকোনো মুল্যে চাই। ও একটা হাত ধরলে অন্য হাতে গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে রাজি আছি। ওর কন্ঠের কাছে পৃথিবীর কোন সুর তুচ্ছ। ধীরে ধীরে জড়িয়ে যেতে থাকলাম ওর সাথে। ও হয়ে উঠলো আমার লিখা গানের সুর, আমর কল্পনার রং। কাইনাত খুব সহজেই কাউকে আপন করে নিতে পারে, কিন্তু ওর আপনের ওই তালিকা খুব সীমিত। আমি প্রায় নিয়মিতই ওর কলেজে যেতাম, এক নজর দেখতে। একটি বার ওর কন্ঠ শুনতে, খুব মিষ্টি কন্ঠ মেয়েটার। কিন্তু তা শোনার সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা এই সৌভাগ্য সাবাইকে দেয়না। ওকে নিয়ে একটা গানের লাইন খুব মনে পড়ছে, লিখেই ফেলি “তুমি জানো না; জানোনারের প্রিয়…তুমি মোর জীবনের সাধনা” এভাবে কেটে গেলো তিনটি বছর, ওর মেডিকেল কলেজের পড়া সেদিন শেষ হলো, যেদিন ও ডিগ্রি হাতে পেলো। পুরো কলেজের সামনে ওকে কোলে তুলে গোল গোল ঘুরিয়ে ওর মাথা ঘুরিয়ে দিয়ছিলাম আর তখন ওর গাউনটা যেন উন্মুক্ত ডানার মতো উড়ছিলো আর ও লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দু’হাতে ওর মুখ ঢেকে রেখেছিলো, আর যেন বলছিলো “হে পৃথিবী তুমি দ্বীধা হও, আমি তোমার মধ্যে ঢুকিয়া বাঁচি” তারপর ওর অনেক বড় বড় স্থান থেকে সম্বন্ধ আসতে থাকে। এর ওর এক মাত্র জবাব ছিলো, না।
এদিকে আমি বেকার, চাল চুলো নেই। মেসে থাকি, অগোছালো জীবন ওর বাবাই বা কি করে ওকে আমার হাতে তুলে দেবেন! এবার কাইনাত একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো, ওর নামের শেষে আমার নামটা জুড়েই নিলো। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। আমিও চেষ্টা করতে থাকলাম কিচু একটা করার। দেড় বছরের মাথায় একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললাম “নিহার টেকনোলজিস” নামে। আমাদের মেয়ের নামে,
ও বলাই হয়নি। ছ-মাস হলো ও আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো উপহারটা দিয়েছে, আমাদের মেয়ে, “নাজনীন নিহার (নিহা) [নামটা আমরা আগেই ঠিক করেছি] আমদের মেয়টা দেখতে একদম আমার মতো হয়েছে আর কাইনাত বলে ওর মতো হয়েছে। বলুন তো কি বিপত্তি! সেদিন একটা গাড়ি কিনলাম, আজ ডেলিভারি নিয়ে বসায় এসে দেখি কাইনাতের বাবা মা এসেছেন। নাতনিকে পেয়ে তারা যারপরনাই খুশি। কাইনাতের বাবা আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন ” আমি জানতাম আমার মেয়ের পছন্দ ভুল হতে পারেনা” এখন আমরা সবাই রওনা দিলাম আমার বাসার দিকে (আমাদের মেয়ের দাদার বাসায়)। শুধু কাইনাত সবার আড়ালে আমার হাত ধরে বললো, আমরা তাহলে পারলাম…
0 মন্তব্যসমূহ