সে আর আমার নেই!

 



 রাত ২:৪৩, হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। মুখ দিয়ে যন্ত্রনা গুলো যেন ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে যাছে, কিন্তু এই যন্ত্রনার ধোঁয়া শেষ হওয়ার মতো না। চেরেনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে যেমন হাজার বছর ধরে রেডিয়েশ ছড়িয়ে যাবে তেমনটাই আমার এই জ্বলন্ত সিগারেটের ধোয়া, পার্থক্য এই যে আমি হাজার বছর বাঁচবো না।

তবে আমি পরোকালে বিশ্বাসী, আমাকে এই বোঝা অনন্তকাল ! তার সাথে আমার তেমন কোন সুখকর স্মৃতি নেই । তবে কিছুতো আছে । আমি এখনো তার ছবিগুলো মুছে ফেলার সাহস পাইনি । এইতো সন্ধ্যা বোলার আগ প্র্যন্ত সব ঠিক ছিলো। হারুন ভাই মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেলেন আর আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে আমার সমগ্র দুনিয়া ওলট-পালটে হয়ে গেলো, বেহাত হয়ে গেল আমার পুরো দুনিয়াটা। আমি এখন অন্তঃসার শুন্য একটা মানুষের খোলস মাত্র আমি আর হারুন ভাই ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম । উনি যখন মাগরিবের সালাত আদায় করার জন্য মসজিদে যান তখনই সামাজিক যোগাযোগের কল্যানে ব্যাপােরটা আমার দৃষ্টিগোচর হয় ।

আমার পরিবার তারই বিবাহের অুনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা আমার দৃষ্টিগোচর হয় এক দিন পর। যদিও আগে থেকে জানলেও আমি কিছুই করতাম না। এখন যা ঘটেগিয়েছে তা আর কোন ভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব না, সম্ভব হলে যেকোন কিছুর বিনিময়ে আমি তা পরিবর্তন করতাম । খুব ভালোবাসতাম ওকে।

আসলে কিছু কিছু জায়গা থাকে সেখানে কাউকে একবার কাউকে স্থান দেওয়া হলে সে স্থানে অন্য কাউকে স্থান দেওয়া যায়না, অনেকটা নন রিরাইটেবল কম্প্যাক্ট ডিস্কের মতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের জোড়া ছবিদেখে আমি স্তম্ভিত, নির্বাক হয়েগিয়ে ছিলাম। প্রথমে নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু বাস্তব তো বাস্তব । তার পরেও মনে হচ্ছিলো আমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি, একটু পরেই ঘুম ভেঙে দেখবো সব আগের মতোই আছে ! নামাজ শেষে বেরিয়ে আশা হারুন ভাইয়ের ডাকে ধাত্বস্থ হয়ে বুঝলাম না, এটা দুঃস্বপ্ন না। রাত ৮টা /৯টা পর্যন্ত ছিলাম হারুন ভাইয়ের সাথে । তারপর যার যার বাসায় চলে যাই দুজনেই ।

আনুমানিক রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে সাইকেলটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। খুব ধীর গতিতে এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে চলছি সাইকেল নিয়ে, এতো রাতে ট্রাফিক জ্যাম নেই রাস্তায় সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে কিছু প্রাইভেট কার, পুলিশের গাড়ি, দুরপাল্লার বাস আর কখনো ট্রাক। না আজকে কোন ভয় লাগছেনা। না মৃত্যু ভয় না পুলিশের ভয়। যখন কারো দুনিয়াটাই বেহাত হয়ে যায় তখন এইসব খুব সাধারণ হয়ে যায়। জেলখানা আর মুক্ত দুনিয়া তার কাছে সমান, কোন ফারাক নাই। না, একটা ফারাক আছে। জেলখানায় নিজের দুঃখ গুলো অন্য কয়েদিদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। হোক অপরাধী বা নিরপরাধ আন্ডার ট্রায়াল, মানুষ তো ! ওই জেলখানার বাইরের দুনিয়ায় এই মানুষের সংখ্যা খুব কম। সবাই ওর মতো, ওর স্বামীর মতো সফল মানুষ !

আমি আর আমার মতো শালারা সমাজের জঞ্জাল, কেউ কেউ আবার ক্যান্সার। তবে কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনা আমি, আমরা কেন সমাজের জঞ্জাল হলাম, ক্যান্সার হলাম। অবশ্য জিজ্ঞাসা করেই বা লাভ কি, আমাদের অধিকাংশের কাছেই এর কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর নেই। যুক্তিযুক্ত উত্তর থাকে সফল মানুষদের কাছে।আমি আমার মতো যারা তারা তাদের নিজেদেরই একটা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সির সুরে মগ্ন থাকি যা তোমরা সফলেরা শুনতে পাওনা পারবাও না। হঠাৎ আমার মনে পড়লো ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের কিছু ছিন্নমুল দাদীর কথা । দুনিয়াতে একমাত্র মানুষ যার আমার কিছু হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে কিছু আসতো-যেত তিনি ছিলেন আমার দাদী। তিনাকে হারিয়েছি আড়াই -তিন বছর হলো। ঠিক করলাম রেলওয়ে স্টেশনের দাদীদের কাছে যাবো। মানে এয়ারপোর্টের ইউটার্ন থেকে ঘুরে আসতে হবে।

তা ঘুরে আসার সময় কুড়িল বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারের নিচে আসতেই নাকে গাঁজার কটু গন্ধ নাকে লাগলো। আমার সাইকেলের একটা শক্তিশালী হেডলাইট আছে, সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে সেদিকে তাক করতেই একজনকে দেখতে পেলাম সাথে সাথে গন্ধের উৎসও বুঝতে পারলাম। হেডলাইটা বন্ধ করে সাইকেলটা ফ্লাইওভারের তলে স্ট্যান্ড করে তার পাসে গিয়ে বসলাম। আমার টিশার্টে জাতিসংঘের লোগো দেখে বললো,

-পুলিশের লোক নাকি মামা ?

আমি- না মামা আমি পুলিশ-টুলিশ না !

-তো এতো রাইতে এই রোডে ঘাটে কি করেন, দেখেতো ভদ্রঘরের লোকই মনে হয়। জানেন না এতো রাতের বেলা এই জায়গা ভালো না। চাক্কু ধইরা মোবাইল, টাকা-পয়সা, সাইকেল সব লইয়া যাইবোগা।

আমি- আপনিও তো আছেন, আপনার কাছ থেকে নিবেনা ।

-ধুরমিয়া, আমার কাছ থেকে নিবো কোন শালায় আর আমার যে মোবাইল !

আমি- আরে ভাই যার দুনিয়াটাই বেহাত হয়ে গিয়েছে তার আবার মোবাইল, টাকা-পয়সা চুরির ভয় !

সে বাঁশিতে ( আপনারা সফল লোকেরা কলকি বলে চিনেন হয়তো ) একটা লম্বা টানদিয়ে বাঁশিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো, তার মতো কায়দা করে বেশ কয়েকটা টান দিলাম। ফুসফুসটা যেন জ্বলে গেলো।

সে- মামা, আপনিতো পুরােটাই শেষ কইরা ফালাইছেন, দিলটা শান্ত হইছে ?

আমি- শুন্য শুন্য ঘোর লাগা মাথা নিয়ে শুধু বললাম ” মামা আমার বুকে যে আগুন ধরছে , সপ্তসাগরের পানি দিয়াও এই আগুন নেভানো যাবেনা [ কোন একটা গানের লিরিক্সে এই লাইনটা শুনেছিলাম, কোন গান মনে নাই ]” বলে একটা হাসি দিলাম । আমার দেখাদেখি সেও হাসি দিলো । চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত আলো-আধারির খেলা, ফ্লাইওভারের ওপর ছুটেচলা গাড়ি তার মধ্যেই বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে রেললাইন ধরে ছুটে চলে গেল একটা মালবাহী ট্রেন আর দুটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের অট্টহাসি একটা অদ্ভুত পরিবেশের অবতারনা করলো। তারপর আমরা আমাদের নিজেদের পথে চলতে লাগলাম রক্তিম চোখ নিয়ে ।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম দিকে গিয়ে দেখলাম স্টেশনের দাদি ঘুমিয়ে আছেন, আমি ডাক দিয়ে বললাম

- দাদি, আমি আসছি । একটু জায়গা দেন শুবো। দাদি- কি হইছে ভাই ? এত রাইতে তুমি ? উনি ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন ।

আমি- সব পরে বলবো, এখন জায়গা দেন । আমি যেন আমার আপন দাদির পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ দাদির ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো, যতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম শুধু ওকেই স্বপ্নে দেখছিলাম । চোখ খুলে, যেন দেখছি আমার আপন দাদি। উনাকে চিনতে ১০/১৫ সেকেন্ড সময় লাগলো, হাতে চায়ের কাপ আর পাওরুটি !

এরাই আমার প্রকৃত আপনজন, এরা আমাকে ভালোবাসে আমার সফলতা বা ব্যার্থতাকে নয়। এরা মানুষ, আপন মানুষ। তথাকথিত সফল মানুষ না। তারপর পুরো ঘটনাটা অশ্রুসিক্ত চোখ বহু ব্যার্থ কৌশলে আড়াল করতে করতে পুরো ঘটনাটা বললাম। উনি বললেন, “কষ্ট পইওনা ভাই, তুমি ওর চাইতে অনেক ভালো কাউকে পাইবা” আমি চোখ মুছতে মুছতে মনে মনে বললাম “ওর চাইতে ভালো না, আমার যে ওকেই চাই যা এখন আর কোন ভাবেই সম্ভব না। ওর জায়গা অন্য কেউ নিতে পারবেনা, আমি দিতেও পারবোনা, আবেগ-অনুভুতির সাথে জড়িত ভালোবাসার মানুষের রিপ্লেসমেন্ট হয়না” 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ